ঢাকাশুক্রবার , ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ঝুঁকি মধ্যে বিশ্বখ্যাত প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন

প্রতিবেদক
সিএনএ

সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১ ১০:৪৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে নতুন করে অবৈধভাবে আবাসিক হোটেল ও কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে। অথচ পাঁচ বছর আগে আদালতের নির্দেশনা ছিল, দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভাঙার। তা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সেখানে নতুন করে প্রায় অর্ধশতাধিক পাকা দালানকোঠা উঠছে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বখ্যাত দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বীপের জেটিঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে উত্তর সমুদ্র সৈকতের তীরে পশ্চিমপাড়ার অবস্থান। সেখানে ‘নিঝুম বাড়ি’ আবাসিক হোটেলে দোতলার কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিকরা। তার আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। অভিযোগ রয়েছে, এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর। এভাবে দ্বীপের পূর্বপাড়া, মাঝারপাড়া ও কোনাপাড়াসহ কয়েকটি পাড়ায় প্রায় অর্ধশতাধিক ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপপ্রবালশূন্য হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে আন সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে। এই দ্বীপে প্রবাল ছাড়াও রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কচ্ছপ, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের প্রাণী।

‘নিঝুম বাড়ি’ আবাসিক হোটেলে নির্মাণের দায়িত্বে থাকা হেলাল উদ্দিন জানান, ‘দ্বীপে ফাইভ স্টার হোটেলসহ অনেক দালানকোঠা নির্মাণকাজ চলছে। দ্বীপে শুধু আমি একা নির্মাণ করছি না, আরও অনেকে দালান নির্মাণ করছেন।’ তার যুক্তি, বিশাল ভবন নির্মাণ হয়েছে তাতে দ্বীপের ক্ষতি হচ্ছে না, সামান্য এ দালানকোঠা নির্মাণে কী আর ক্ষতি হবে।’

পূর্বপাড়া দালানকোঠা নির্মাণকারী মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘দ্বীপে দেড় শতাধিকের বেশি ছোট-বড় আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মাঝেও অনেকে কটেজ নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা তো কেউ অনুমতি নেননি। তাদের মতো আমি একটি ছোট কটেজ নির্মাণ করছি। এখানে অনুমতির কী আছে?’

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, পর্যটক মৌসুমকে সামনে রেখে দ্বীপে তাড়াহুড়া নতুন করে চলছে আবাসিক হোটেলের কাজ। তবে কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদফতর, প্রশাসনসহ সরকারি কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) সেন্টমার্টিন দ্বীপে এ সব স্থাপনা নির্মাণকাজ চলছে। এই চক্রের যোগসাজশে প্রকাশ্যে টেকনাফ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সংশ্নিষ্ট দফতর ম্যানেজ থাকায় এসব নির্মাণসামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনও বাধা ছাড়াই গড়ে উঠছে হোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে। এদিকে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। নির্দেশনা মতে, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনও স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘দ্বীপে রাস্তাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের নামে নিয়ে যাওয়া ইট, বালু, সিমেন্ট ও কংক্রিট দিয়ে সেখানে নতুন করে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে অর্ধশতাধিক ছোট-বড় আবাসিক হোটেল ও কটেজ। আইন প্রয়োগ না করার কারণে আজ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হারিয়ে যাওয়ার পথে। এখানে আইন আছে শুধু স্থানীয়দের জন্য।’

তবে কোস্ট গার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া কাউকে এখানে দালানকোঠা নির্মাণের জন্য মালপত্র আনতে দেওয়া হচ্ছে না। অনুমতি ছাড়া কোনও মালপত্র পেলে সেগুলো জব্দ করা হচ্ছে।’

সেন্টমার্টিনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশনার মধ্যেই নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে কক্সবাজারের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালীরা দ্বীপে প্রকাশ্যে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নতুন ভবন নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশপাশি অতি দ্রুত আদালতের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। তা না হলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।’

সেন্টমার্টিন রক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে হবে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘নতুন করে মালপত্র নিয়ে দালানকোঠা নির্মাণের কোনও সুযোগ নেই। সম্প্রতি অবৈধভাবে মালপত্র নেওয়ায় আট জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তবু কেউ যদি দালনকোঠা করে থাকে সে বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘অবৈধভাবে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তবু তারা কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশেষ করে দ্বীপে পরিবেশ পরিবেশ অধিদফতরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।’

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের বিষয়ে সম্প্রতি সময়ে মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। আমরা দ্বীপ রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবো।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘অবৈধ দালানকোঠা নির্মাণের তথ্য পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে এর আগে আদালত পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি ছোট-বড় আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশনা দিলে তার বিরুদ্ধে আপিল করে হোটেল মালিকপক্ষ। এরপর কার্যক্রমটি থেমে আছে। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটির এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

সম্পর্কিত পোস্ট
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com