ঢাকারবিবার , ২৩ জানুয়ারি ২০২২
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ভালোবাসার সংগঠন ট্যুরিস্ট পুলিশ- বনজ কুমার মজুমদার

প্রতিবেদক
সম্পাদক

জানুয়ারি ২৩, ২০২২ ১১:০২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

সম্পাদক :

ভালোবাসার সংগঠন ট্যুরিস্ট পুলিশ
————–
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ছিলাম। দেখতাম পর্যটকরা বিকেলে জড়ো হয় সৈকত পুলিশ ফাঁড়ির কলাতলী সমুদ্র সৈকতে। পারলে একজনের গায়ের উপর দিয়ে অপর জন সূর্য ডোবা দেখে। মোটেল শৈবাল হয়ে ডায়াবেটিক হাসপাতালের ঐ দিকটার সৈকতে কেউ যেতে চায় না। হিমছড়িতে সারাদিন পর্যটকদের আনাগোনা। সন্ধ্যার আগে শুন-শান নিরবতা। ম্যারিন ড্রাইভেরও একই অবস্থা। গভীর রাতে জ্যোস্না দেখতে যখন ইনানী সৈকতে যেতাম, তখন জন-মানবহীন এ সৈকতে কয়েকটি কুকুর ছাড়া কাউকেই দেখতাম না। কুকুরগুলো আশ্চর্য হয়ে আমাদের দেখত! বন বিভাগের একটি রেস্ট হাউজ ছাড়া ছিল না কোন স্থাপনা। রাতের মহেশখালীর আদি নাথ মন্দিরের কথা না-ই বা বললাম।
সৈকতে যারা অর্থের বিনিময়ে সেবা দিয়ে থাকেন তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে ছোট-খাট অভিযোগ ছিল। তখন মোবাইলে ক্যামেরা ছিল না-ভরসা ছিল সৈকতের ক্যামেরাম্যানরা। ছবি তোলা ছিল ব্যয়বহুল কাজ। যারা বেড়াতে আসতেন তারা অগ্রীম প্রদানের ভিত্তিতে মৌখিক চুক্তিতে ছবি তুলতেন – কথা থাকতো ছবি প্রিন্ট করে তাদের নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। সবক্ষেত্রে চুক্তির সততা মানা হতো না। সৈকতের কেউ কেউ সেবা প্রদানে দর-দামের ক্ষেত্রে সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমতো দর হাকাঁতেন। চুরি ছিল মোটামুটি সাপ্তাহিক ঘটনা। সন্ধ্যায় দেখতাম কুপি বাতি জ্বালিয়ে চিংড়ি মাছের পোনা ধরতো অনেকেই। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। একটা পোনা ধরার জন্য হাজার হাজার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রানের জলাঞ্জলি। এরা কাপড় দিয়ে জল ছেকে হাড়িতে রাখে এবং পরবর্তীতে কাঙ্খিত পোনাটি রেখে পুরোটাই বালুতে ফেলে দেয়। এ ক্ষুদ্র প্রানীগুলো রক্ষার দায়িত্ব কেউ নেয় না।
আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি ছিল সন্ধ্যা ৭-৮ টার পর বাঁশি ফুকিয়ে সৈকত খালি করা – যাতে কোন পর্যটক কোন অপরাধের স্বীকার না হন। কিন্তু এরপর পর্যটকরা কি করবেন ? হোটেল-মোটেলে ঘুমানো আর রাতের খাবার ছাড়া তাদের কোন কাজ নেই! রাতের সমুদ্র দেখার অধিকার তাদের নেই ? আমরা একটি অস্থায়ী পরিকল্পনা নেই – ডায়াবেটিক হাসপাতাল-পুলিশ অফিসার্স মেস (পুরাতন)-জেলা প্রশাসকের বাসভবন-ডলফিন মোড়-কলাতলী সৈকত পর্যন্ত ২৪/৭ ঘন্টা নিরাপত্তা দেবার। বান্দরবান এপিবিএন হতে অতিরিক্ত ফোর্স আসে। মাস ছয়েক পর দেখা যায় – এটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে যে পরিমাণ তদারকী দরকার সে সামর্থ পুলিশ সুপারের নেই।
আমরা চাচ্ছিলাম পর্যটকরা যেন আদিনাথ মন্দির হতে ইনানী সৈকত পর্যন্ত ২৪ ঘন্টা উপভোগ করতে পারেন – সেজন্য দরকার তাদের সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা। নিরাপত্তা থাকলে এ এলাকায় পর্যটক-বান্ধব সুবিধা তৈরির উদ্যোক্তারা এমনিতেই এগিয়ে আসবেন। আমরা জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত “বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি”-তে প্রস্তাব দিই পুলিশ সুপারের অধীনে “ট্যুরিস্ট পুলিশ” গঠনের। তখন এ কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতেন কক্সবাজারের যৌথ বাহিনী ও ডিজিএফআই-এর অধিনায়কবৃন্দ। সকলেই “ট্যুরিস্ট পুলিশ”-র প্রস্তাবের প্রশংসা করেন এবং কার্যবিবরণীতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। পরবর্তী মাসে জেলা আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সভায়ও এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। জেলা প্রশাসক জনাব সাজ্জাদুল হাসান ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের জেলা প্রশাসকদের উন্নয়ন সভায় “ট্যুরিস্ট পুলিশ” প্রস্তাবটি গ্রহন করান।
ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রস্তাব পুলিশ হেডকোয়াটার্র্স-এ প্রেরণের সময় পরিবেশবিদ জনাব রাগিব উদ্দীন আহাম্মেদ এবং প্রথম আলোর জনাব আব্দুস কুদ্দুস রানা আমাদের ইকোট্যুরিজমের ধারণাটি দেন। আমরা সেটি গ্রহণ করি। আমাদের প্রস্তাবনায় ছিল ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়িত্বে থাকবে পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ সকল ধরনের সেবা দানে সহযোগিতা করা এবং সমুদ্র সৈকতের জীব- বৈচিত্র সংরক্ষণে সাহায্য করা। সব বিবেচনায় ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রস্তাবনায় একটি হেলিকপ্টারও রাখা হয় সমুদ্রের ভাটার টানে ভেসে যাওয়া মানুষদের উদ্ধারের জন্য। শ্রদ্ধেয় আইজিপি স্যার বিষয়টির প্রশংসা করেন। কক্সবাজারের গণমাধ্যম কর্মীগণ, হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি, জেলা কমিউনিটি পুলিশ এবং আমরা সবাই যে যেখানে সুযোগ পেতাম সবাই ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষে কথা বলতাম। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন পর্যটন কপোর্রেশনের চেয়ারম্যান জনাব শফিক আল মেহেদী শ্রদ্ধেয় স্ব-রাষ্ট্র সচিব জনাব মোঃ আব্দুল করিম ও আইজিপি জনাব নূর মোহাম্মদ মহোদয়’দের ডিও লেটার লেখেন। স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) জনাব এম এ মতিন মহোদয় আমার সাথে কথা বলেন। সকলের আগ্রহের কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চলে যায়।
সে সময় আমরা একটি বিষয় লক্ষ্য করি – সবার মধ্যেই পর্যটকদের সেবার মান বাড়ানোর আগ্রহ কাজ করছে। আমরা সুযোগটি কাজে লাগাই। সৈকতে সেবার মান বাড়ানোর জন্য একদিনের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করি। এতে পর্যায়ক্রমে অংশগ্রহণ করেন সৈকতে সেবা প্রদানকারী সকল বেসরকারী কর্মী যেমন – ফটোগ্রাফার, টিকটক ও স্পীডবোর্ডের কর্মী, ফেরীওয়ালা ইত্যাদি। আমাদের সাথে কথা বলে ইউএনডিপি ও পিআরপি (পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রাম)। উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে নিয়ে সৈকতে চুরি, দরদামের প্রতারণা ও ইভটিজিং বন্ধে সাহায্য নেয়া, সৈকত পরিস্কার রাখা, সামুদ্রিক প্রানী রক্ষা এবং পর্যটকদের সহযোগিতা করা। এ সকল কর্মীদের পূর্ব চরিত্র যাঁচাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় কমিউনিটি পুলিশ নেতৃবৃন্দকে। আমাদের সুপারিশ পেলেই বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব পরিচয়পত্র দেবেন। এ আইডি কার্ড ব্যতীত কাউকেই সৈকত সেবা দিতে দেয়া হবে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় কক্সবাজার বেড়াতে আসেন। তখন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জনাব ইমাম হোসেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রস্তাবনাটি তাঁর কাছে উপস্থাপন করায় তিনি এর প্রশংসা করেন। তিনি ফিরে যাবার কিছুদিন পর “ট্যুরিস্ট পুলিশ” গঠনের প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করে।
এখন ট্যুরিস্ট পুলিশের অবয়ব বিশাল। কক্সবাজারের সকল স্তরের মানুষের ভালোবাসার সংগঠন ট্যুরিস্ট পুলিশ। পর্যটকদের জন্য সমুদ্র সৈকত এখন ইনানী ছাড়িয়ে শামলাপুর পর্যন্ত চলে গেছে। পর্যটন উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য একদিন বাংলাদেশ পুলিশের অহংকার হবে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
বিঃ দ্রঃ এ লেখাটি ট্যুরিস্ট পুলিশ, বাংলাদেশ এর ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ট্যুরিস্ট।। TOURIST নভেম্বর,২০২১ –এ প্রকাশিত হয়।

সম্পর্কিত পোস্ট
Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com