করোনা আক্রান্ত সংকটাপন্ন বা গুরুতর রোগীরা জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে আসছে ঢাকায়। রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর সামনে দিনভর আসে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স।
করোনা আক্রান্ত সংকটাপন্ন বা গুরুতর রোগীরা জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে আসছে ঢাকায়। রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর সামনে দিনভর আসে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স।
ঠিক দুই সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর জুলাই মাসকে কঠিন বলে আখ্যায়িত করেছিল। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি শঙ্কা জানিয়েছিল, স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীন হলে দেশে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। দুই সপ্তাহ পর এসে সেই আশঙ্কাকে সত্যি করে দেশে করোনা মহামারিকালের সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং হতাশার পরিস্থিতি দেখতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।
দেশে করোনার ১৬ মাস চলছে। আর এই সময়ের ভেতরে গত ২৪ ঘণ্টায় দৈনিক রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১৬ হাজারের বেশি। একদিনে এত রোগী শনাক্ত এর আগে বাংলাদেশ দেখেনি।
গত একদিনে নতুন করে শনাক্ত হওয়া ১৬ হাজার ২৩০ জনকে নিয়ে দেশে করোনাতে সরকারি হিসাবে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেলো। দেশে সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হলেন ১২ লাখ ১০ হাজার ৯৮২ জন। আর এই ১২ লাখ রোগীর মধ্যে লক্ষাধিক শনাক্ত হয়েছেন মাত্র ১০ দিনে। এর আগে গত ১৮ জুলাই দেশে করোনাতে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। একদিনে রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্তের দিনে দেশে করোনাতে মৃত্যু ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে আক্রান্ত হয়ে ২৩৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
গত বছরের ৮ মার্চে দেশে করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হন। তারপর গত বছরের জুনের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে আগস্ট পর্যন্ত দেশে করোনার রোগীর ঊর্ধ্বগতি ছিল। এরপর শীতের সময়ে সংক্রমণ কমে এসে রোগের নিম্নগামীতা ছিল চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত। এরপর থেকে দেশে করোনার ঊর্ধ্বগামীতা শুরু হয়। তবে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় এসেছে গত দুই মাস ধরে।
বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটে বাংলাদেশেও দৈনিক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে কয়েকগুণ। করোনার ঊর্ধ্বগতিতে চলতি মাসের দুই সপ্তাহ দেশে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু ঈদুল আজহা উপলক্ষে তা শিথিল করা হয়। আর এই সুযোগে বাস, লঞ্চ, ফেরিতে গাদাগাদি করে ঢাকা ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে মানুষ। আবার শিথিল লকডাউন শেষে কঠোর লকডাউনের আগে যেভাবে ঢাকা ছেড়েছিল, ঠিক সেভাবেই ফিরেছে তারা।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা সে সময়ে বলছিলেন, শিথিলতার এ নির্দেশনায় তাদের ‘সায়’ ছিল না। তারা বলছেন, সরকারের শিথিল বিধিনিষেধের এ ঘোষণা তাদের পরামর্শের উল্টো চিত্র। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিল, স্বাস্থ্য অধিদফতর যেখানে বার বার ভিড় এড়িয়ে চলার কথা বলছে; সেখানে সংক্রমণের ‘পিক টাইমে’ এ ধরনের ঘোষণা আমাদের আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে।
সে আশঙ্কাকে সত্যি করে দেশে ঈদের পর থেকে দৈনিক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর একের পর এক রেকর্ড দেখতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আর এতে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা তালিকায় বিশ্বে এখন দিনে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে যেসব দেশে, সেই তালিকায় অষ্টম অবস্থানে বাংলাদেশ।
কঠিন জুলাই
জুলাই নিয়ে শঙ্কার কথা আগেই জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ১৪ জুলাই ঠিক দুই সপ্তাহ আগে জুলাই মাস অত্যন্ত কঠিন মন্তব্য করে অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছিলেন, ‘জুনে এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছিল, আর জুলাইয়ের ১৪ দিনে আমরা এত রোগী পেয়ে গেছি। এই মাসের আরও ১৬ দিন বাকি আছে। যেহেতু সংক্রমণের মাত্রা এখন অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, দুই সপ্তাহ পর্যন্ত টানা এভাবে চলতে পারে। আর মৃত্যু তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এভাবে চলতে পারে।’
অধ্যাপক রোবেদ আমিনের সে আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে দেশে দৈনিক শনাক্তে রেকর্ড সংখ্যক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। কেবলমাত্র জুলাই মাসে রোগী শনাক্ত হয়েছেন দুই লাখ ৯৭ হাজার ৭২৪ জন আর মোট মৃত্যুর এক চতুর্থাংশ হয়েছে এই মাসে। জুলাইতে মারা গেছেন পাঁচ হাজার ৫১৩ জন।
গত বছর থেকে বিভিন্ন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট ও ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন নিয়ে বাংলাদেশ সংগ্রাম করে যাচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেছিলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, বর্তমান সময়ের করুণতম পরিস্থিতির উপক্রমে আমরা চলে এসেছি। যেখানে সংক্রমণের মাত্রা ও মৃত্যু ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
১০ দিনে শনাক্ত ১ লাখ রোগী
দেশে শনাক্ত হওয়া মোট ১২ লাখ ১০ হাজার ৯৮২ জনের মধ্যে সর্বশেষ ১০ দিনে এক লাখ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ২৩০ জন, ২৭ জুলাই ১৪ হাজার ৯২৫ জন, ২৬ জুলাই ১৫ হাজার ১৯২ জন, ২৫ জুলাই ১১ হাজার ২৯১ জন, ২৪ জুলাই ছয় হাজার ৭৮০ জন, ২৩ জুলাই ছয় হাজার ৩৬৪ জন, ২২ জুলাই তিন হাজার ৬৯৭ জন, ২১ জুলাই সাত হাজার ৬১৪ জন, ২০ জুলাই ১১ হাজার ৫৭৯ জন, ১৯ জুলাই ১৩ হাজার ৩২১ জন আর ১৮ জুলাই শনাক্ত হন ১১ হাজার ৫৭৮ জন।
এই ১৮ জুলাইতে ১১ হাজার ৫৭৮ জনকে নিয়ে সেদিন মোট ১১ লাখ তিন হাজার ৯৮৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর।
সরকারি আইসিইউ ফাঁকা মাত্র ৯টি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, ঢাকার সরকারি ১৬ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনটি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা থাকলেও আইসিইউ নেই। হাসপাতাল তিনটি হচ্ছে— সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল।
বাকি হাসপাতালগুলোর মধ্যে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ২৬ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০ বেড, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেড, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয় বেড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেড, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ বেড, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ বেড, টিবি হাসপাতালের চার বেড এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের সবগুলোতে রোগী ভর্তি।
আর অন্য হাসপাতালগুলোর মধ্যে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪ বেডের মধ্যে একটি, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আট বেডের মধ্যে একটি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০ বেডের মধ্যে তিনটি এবং ডিএনসিসি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ২০৬ বেডের মধ্যে চারটি বেড ফাঁকা রয়েছে।
অর্থাৎ, ঢাকায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ১৬ হাসপাতালের ৩৭৫টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ৩৬৬ জন, ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৯টি বেড।
অপরদিকে, বেসরকারি ২৮ হাসপাতালের ৪২৭টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৮৪টি। সারাদেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সরকারি ও বেসরকারি ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর ৭৯৩টি আইসিইউ বেডের ফাঁকা বেডের সংখ্যা ১০০টিরও কম। অধিদফতর জানাচ্ছে, আইসিইউ বেড সবমিলিয়ে ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৯৩টি বেড।
সবাইকে নিয়ে সেই বিপদেই পড়তে হলো
অধ্যাপক রোবেদ আমিন জানিয়েছিলেন, ‘হাসপাতালে যদি আর নতুন রোগীকে জায়গা দেওয়া না যায়, তাহলে আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাবো’। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে হাসপাতাল বাড়িয়েও লাভ হবে না বলেও বাংলা ট্রিবিউনকে একাধিকবার জানিয়েছেন তিনি।
তার সেই কথার প্রতিফলন হচ্ছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কণ্ঠে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ঢাকাতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত বেড রয়েছে ১৬৯টি, কিন্তু সেখানে রোগী ভর্তি আছেন ১৭১ জন। বেডের অতিরিক্ত দুই জন ভর্তি আছেন। একইভাবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে বেড রয়েছে ২৭৫টি, সেখানে ভর্তি আছেন ৩৬১ জন। বেডের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন ৮৬ জন। আর সারাদেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ১৪টি হাসপাতালে নির্ধারিত বেডের চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন।
‘বেড বাড়িয়েও লাভ হচ্ছে না’ মন্তব্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) তার হাসপাতালে ১০০ বেড বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এর আগে কয়েক ধাপে ১০০, ২০০, ৩০০ বাড়িয়েছিলাম। এখন ৪ শ’ করা হলো।
আগামী কয়েকদিনের ৫ শ’ বেড করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ঈদের পরে যেভাবে রোগী আসতেছে… ১০০ বেড বাড়ানোর পরেও সেগুলো ভরে যাচ্ছে।
গতকাল ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৬২ জন জানিয়ে তিনি বলেন, একটা হাসপাতালে ৬২ জন ভর্তি হওয়া তো যাতা কথা নয়! আর এভাবে যদি বাড়তে থাকে তাহলে কত বেড বাড়ানো যাবে? আমাদেরতো একটা লিমিটেশনস আছে মন্তব্য করে খলিলুর রহমান বলেন, এত সংক্রমণ যদি চলতে থাকে তাহলে সত্যি কথা বলতে হাসপাতালে জায়গা দেওয়া যাবে না। আমাদের আসলে সবাইকে মিলে সেই বিপদেই পড়তে হলো।
বেড ফাঁকা নাই। আইসিইউ, সাধারণ বেড- কিছুই ফাঁকা নেই বলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
এটাই হওয়ার কথা ছিল মন্তব্য করে ব্রিগেডিয়ার নাজমুল বলেন, কোনও হাসপাতালেই বেড ফাঁকা থাকার কথা না, পুরো ঢাকা শহর হাসপাতাল বানাতে হবে। সবাই মিলে আমরা আসলে বিপদেই পড়লাম।