বরিশালের উজিরপুর থানায় রিমান্ডে নিয়ে হত্যা মামলার এক নারী আসামিকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের ঘটনায় ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষার পর আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। রবিবার (৪ জুলাই) বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তবে এ বিষয়ে কিছু বলতে অপরাগতা জানান তিনি।
তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর আসামি মিতুর শারীরিক অবস্থা জানিয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও কিছু বলতে পারছি না।
তবে হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) ইনচার্জ এসআই আব্দুল জলিল বলেন, একটি হত্যা মামলার আসামি ছিলেন ওই নারী। তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আনার পর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। চিকিৎসা শেষে পুলিশ তাকে কারাগারে নিয়ে গেছে।
গত শুক্রবার (২ জুলাই) হত্যা মামলার রিমান্ড শেষে বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় ওই নারীকে। এসময় রিমান্ডে যৌন নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেন আসামি। পরে আদালতের বিচারক মাহফুজুর রহমান আসামির অভিযোগ আমলে নিয়ে নির্যাতন এবং হেফজতে মৃত্যু ধারা মোতাবেক অনতিবিলম্বে মিতুর দেহ পরীক্ষা করে জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখপূর্বক প্রতিবেদন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
নারী আসামির ভাই অভিযোগ করেন, উজিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ছিল আমার বোন। গ্রেফতার করে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পরপরই এক নারী পুলিশ সদস্য লাঠি দিয়ে তাকে মারধর করেন। পরে উপস্থিত সার্কেল এসপিও তাকে লাঠি দিয়ে পেটান। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ৩০ জুন দুই দিনের রিমান্ডের জন্য তাকে ফের থানায় নেওয়া হয়। এদিন তাকে মারধর না করা হয়নি। তবে পরেরদিন সকালে (১ জুলাই) মামলার তদন্ত কর্মকর্তার রুমে আমার বোনকে ডেকে পাঠানো হয়। এ সময় উক্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মাইনুল আমার বোনকে যৌন নিপীড়ন করেন। এরপর এক নারী পুলিশ সদস্যকে ডেকে এনে তাকে দিয়ে আমার বোনকে লাঠিপেটা করান। এক পর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও তাকে লাঠি দিয়ে পেটান।
তিনি আরও বলেন, ১৫ থেকে ২০ মিনিট পেটানোর পর আমার বোন জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরে সে নিজেকে হাসপাতালে হাতে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় দেখতে পায়। পরবর্তীতে আমার বোনকে ফের থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং ওসির রুমে নিয়ে হাজির করা হয়।
তখন পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে খুনের অপরাধ স্বীকার করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু আমার বোন তা স্বীকার করেনি।
ওই নারী আসামি বর্তমানে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে ওই নারী আসামির পরিবারের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, নির্যাতনের বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুমকি দিয়েছেন থানার পুলিশ সদস্যরা। এমনকি এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য স্থানীয় একজন সাবেক এমপিকে দিয়েও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে উজিরপুর মডেল থানার ওসি জিয়াউল আহসান বলেন, থানায় রিমান্ডের সময় নারী আসামির ওপর শারীরিক বা যৌন নির্যাতন করা হয়নি। রিমান্ডে নিলে সবাই পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে বলে পাল্টা অভিযোগ করেন তিনি।
মিতুর আইনজীবী মজিবর রহমান বলেন, বিভিন্ন স্থানে পুলিশের হেফাজতে আসামি মারা যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমার মক্কেলকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আরজি করা হয়েছিল। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে সতর্কতার সঙ্গে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ মিতুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছে। এটা গুরুতর অন্যায়। তিনি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
বরিশাল জেলা মানবাধিকার জোটের যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ রিমান্ডে নারী আসামির ওপর শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান তিনি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, রিমান্ডে নারী আসামিকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন উজিরপুর উপজেলার জামবাড়ি এলাকা থেকে বাসুদেব চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তার ভাই বরুণ চক্রবর্তী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামি হিসেবে ওই নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। থানা পুলিশের পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ জুন বরিশালের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উজিরপুর আমলি আদালত আসামির দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে গত ২ জুলাই মিতুকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।