সিএনএ ডেক্স: কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিক সন্ত্রাসী দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরা চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণ-চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই সব করে বেড়ায়। অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হরহামেশাই মহড়া দেয় তারা। রাতের পরিবেশ হয়ে ওঠে আরও বেশি ভয়ঙ্কর। সংঘবদ্ধ এসব সন্ত্রাসী দলের সদস্যদের নেপথ্যে থেকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেক সিআইসি বা ক্যাম্প ইনচার্জের বিরুদ্ধেও। সরেজমিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পুলিশের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘কিছু রোহিঙ্গা সংঘবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। এজন্য আমরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করার চেষ্টা করি। যদিও একসঙ্গে এত লোক অবস্থান করার কারণে পুরো জায়গাটাই ভালনারেবল। আমরা এখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য আমাদের আরও সতর্কতার সঙ্গে কিছু কর্মপরিকল্পনা করার প্রয়োজন। সেসব বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সন্ত্রাসী দল হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক নম্বরে রয়েছে আরসা বা আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। যাদের মিয়ানমারের ভাষায় তানজিম ও আরবি ভাষায় আল ইয়াকিন বলা হয়। কিন্তু ক্যাম্পের স্থানীয়রা তাদের হালেকিন বলে ডাকে। মৌলভি আয়াছ, মোহাম্মদ মুছা ও আরমান নামে তিনজন এই সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা। তাদের দলে সরাসরি সক্রিয় রয়েছে অন্তত ১৩৫ জন। এছাড়া নবী হোসেন গ্রুপের নেতা নবী হোসেন। তার বাবার নাম মোস্তাক আহমেদ। তার দলে অন্তত ৭২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া আরেকটি গ্রুপ হলো দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্সগ্রুপ। এর নেতৃত্ব দিচ্ছে দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্স। তার দলে অন্তত ২৯ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। হিট পয়েন্ট বা কলিম উল্লাহ গ্রুপের নেতা কলিম উল্লাহ। তার দলে রয়েছে অন্তত ২০ জন সদস্য। মৌলভী শহীদুল গ্রুপের নেতা শহীদুল ইসলাম। তার দলে রয়েছে অন্তত ৭৬ জন সদস্য। এছাড়া মৌলভী আইয়াছ গ্রুপ, আলম গ্রুপ ও হাসিম গ্রুপের সদস্যরাও সক্রিয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা অপরাধ করে ক্যাম্প এলাকার আশেপাশের পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে কুতুপালং ক্যাম্প -৬, বালুখালী ক্যাম্প-৮, তানজিমার খোলা ক্যাম্প-১৮, লম্বাশিয়া ক্যাম্প-১ তেলখোলা, শফিউল্লাহকাটা, ঝুমেরছড়াসহ আশেপাশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের জন্য গোপন মিটিং করে থাকে। এসব এলাকা দুর্গম হওয়ায় এবং গাড়ি যোগাযোগের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় খবর পাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে পারে না। এছাড়া সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ দিনের পর দিন ক্যাম্পের বাইরে আত্মগোপন করে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণে পাহাড়ে গিয়ে সন্ত্রাসীদের সবসময় গ্রেফতার করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, সন্ত্রাসী গ্রুপের অনেকের সঙ্গেই ক্যাম্পে দায়িত্বপালনকারী একাধিক সিআইসি বা ক্যাম্প ইনচার্জের যোগাযোগ রয়েছে। পুলিশের একটি প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ৩ এপ্রিল পুলিশ জানতে পারে সন্ত্রাসী নবী হোসেন কুতুপালংয়ের একজন ক্যাম্প ইনচার্জের সঙ্গে অবস্থান করছে। উখিয়া থানা পুলিশ বিষয়টি জানতে পেরে নবীকে ধরতে যান। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন ওই ক্যাম্প ইনচার্জ নবীকে নিয়ে বাসায় গিয়েছেন। পরে পুলিশ তার বাসায় যায়। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ওই ক্যাম্প ইনচার্জ নবীকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে তাকে একটি অপহরণ মামলায় কারাগারে পাঠালেও কিছুদিন পরই জামিনে বের হয়ে আবারও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে নবী।
ওই প্রতিবেদন বলা হয়েছে, চলতি বছরের ২৭ মে পুলিশ জানতে পারে ওই ক্যাম্প ইনচার্জ সন্ত্রাসী গ্রুপ নসরুল্লাহ, নবী, ইউনুছ, রাজ্জাক, মহিবুল্লাহ, নুরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিটিং করছে। খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গেলেও ওই ক্যাম্প ইনচার্জ বিষয়টি টের পেয়ে বাড়ির বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে সন্ত্রাসীদের পেছন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও ঢাকার গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন ছদ্মবেশে আল-কায়েদার অনুসারী হিসেবে পরিচিতি আনসার আল ইসলাম ও হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী, বাংলাদেশ-এর কিছু সদস্যও কাজ করছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এদের অনেক সদস্যই নিয়মিত কক্সবাজার থেকে চোরাই পথে আরকানে যাতায়াত করে থাকে। বর্তমানে তারা যদিও আরকানের স্বাধীনতার দাবিতে তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু ভবিষ্যতে তারা বাংলাদেশের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থিরতা বাড়তে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতা কমে এলে ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও বেড়ে যাবে। এজন্য দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।