ঢাকাশুক্রবার , ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কক্সবাজার খরুলিয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে ইয়াবা গডফাদারেরা, এলাকায় আতংক

প্রতিবেদক
সিএনএ

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১ ১০:২১ অপরাহ্ণ
Link Copied!

এম শফিক:
এলাকাবাসী, পঞ্চায়েত কমিটি, ওয়ার্ড মেম্বার, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর-সবাই জানে, কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া নয়াপাড়া এলাকায় মাদকের মূল ব্যবসায়ী কারা। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও আছে। প্রশাসনের কাছে আছে তাদের বাসাবাড়ির ঠিকানাও। কিন্তু তারা আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

স্থানীয়রা বলছে, নয়াপাড়া এলাকায় মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন নাজির হোসেন ও তার সহযোগী গফুর। তারা টেকনাফের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইয়াবা এলাকায় আনেন। বিক্রি করেন তাদের সহায়তাকারীরা। এর মধ্যে গফুর এলাকায় ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত। বাজার পাড়ার ইয়াবা ব্যবসাও তার হাতে। আর পুরো সিন্ডিকেটটির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন নাজির হোসেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, তথ্য থাকলেও কৌশল ও জনবলের দিক দিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না তারা। আর পুলিশ বলছে, মাদকের এই হোতাদের ধরতে তাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে।

সদরের ঝিলংজাস্থ খরুলিয়ার নয়াপাড়া গ্রামের নাজির হোসেন প্রকাশ মাজুর নাজির। সাধারণ মানুষের সহানুভূতিকে পুঁজি করে একের পর এক ইয়াবা চালান দিয়ে যাচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক রামুর মরিচ্যায় বিজিবির হাতে ৩০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আবুল কালাম নামের এক টমটম চালক আটক হলে খরুলিয়ার ভদ্রবেশি নাজির-গফুর সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্টতার তথ্য বের হয়ে আসে।

অনুসন্ধানে জানা যায়- নয়াপাড়ার মৃত সাহাব মিয়ার পুত্র নাজির হোসেন (৪৫) বৈবাহিক জীবনে পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক। দুই যুগ আগে রামু চৌমুহনী ষ্টশনে একটি কম্পিউটার ক্লিনিকের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দিনে এনে দিনে খেয়ে বেশ সুখস্বাচ্ছ্যন্দেই পার হচ্ছিলো জীবন। কিন্তু বছর দশের আগে অসৎ সঙ্গীর পাল্লায় পড়ে অবৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়শিয়ায়। সেখানে ধরা পড়ে অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে ফিরেন দেশে। কিন্তু জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন সাজাতে দেশে ফিরেই বেছে নেন মাদক পাচারের মতো কর্মের। ফাঁদে পড়েন ইয়াবার। পাচার নির্বিঘ্নে করতে নিপুনতার সাথে একটি সেটাপও গড়ে তুলেন। প্রধান সহযোগী হিসেবে দলে ভেড়ান নিজের খালাতো ভাই গফুরসহ কয়েকজনকে।

দৃশ্যমান বৈধ কোনো আয় না থাকা সত্বেও ঘরে রাখেন একাধিক কাজের ছেলে। নিজের বাড়িটি করেছেন শীতাতপ (এসি) নিয়ন্ত্রিত। সন্তানদেরকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিভিন্ন অভিজাত স্কুলে ভতি করিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার প্রতিমাসের ব্যায় দাঁড়ায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। মাস কয়েক আগেও নাজিরের ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে তার কাজের ছেলে ঢাকায় আটক হয়। ওই ঘটনায় নাজিরের বাড়িতে পুলিশ তদন্তে এলে পুলিশকে তড়িৎ গতিতে ম্যানেজ করে ফেলে এই ধূর্ত প্রকৃতির ইয়াবা কারবারী।

ইয়াবা পাচারের কাজে ব্যবহার করতে কয়েকটি সিএনজিসহ একটি ট্রাক নিজে ক্রয় করেন এবং আর কিছু টমটম চালককে হাত করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকে। একারণে যতবারই নজিরের মাল ধরা পড়েছে কখনই নাজিরকে পুলিশ আটক করতে পারেনি। পাচারে সহায়তাকারী ট্রাক চালক, টমটম চালক বা সিএনজি চালকরা আটক হলেও অধিক উপার্জনের আশায় কেউ কেউ মুল মালিকের নাম প্রকাশ করেন না। কিন্তু সম্প্রতি ৩০ হাজার ইয়াবাসহ এক অটোরিক্সা চালক আটক হলে তার পরিবার নাজির ও গফুরের সংশ্লিষ্টতার বিষটি ফাঁস করে দেয়।

স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানিয়েছে- নাজির দীর্ঘদিনের পুরোনো ইয়াবা ভেন্ডার। তার কোনো ব্যবসা বাণিজ্য নেই। কর্মও নেই। কিন্তু চলাফেরা করেন বেশ আভিজাত্যের সাথে। সবকিছুতেই তার বিলাসিতার ছাপ। নিয়মিত প্রাইভেট নোহা-কারে করে যাতায়াত করেন স্বপরিবারে। অভিযোগ রয়েছে, মাদকের টাকায় সন্তাদের নামী দামী স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। তাহলে গ্রামবাসী খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছে পঙ্গু নাজিরের এতো টাকা আয়ের উৎস কি?

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, নাজিরের বাসা নয়াপাড়া আর গফুরের বাজার পাড়া হলেও মুলত নাজিরের বাড়ির পাশে তার প্লোট্রি ফার্ম। দীর্ঘদিন থেকে নাজির এই বাড়িতেই গোপনে ইয়াবার ব্যবসা করতেন। পরে ব্যবসার তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে কৌশল পাল্টিয়ে ফেলেন। এখন তিনি এলাকায় গফুরসহ সহকারীদের হাতে ইয়াবা তুলে দিয়ে চলে যান।

সর্বশেষ তার ইয়াবার চালান পাচার করতে গিয়ে ৩০ হাজার ইয়াবাসহ অটোচালক আটক হয়। এরপর থেকে নাজির গফুরের নাম উঠে আসে বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে। বেশ কিছুদিন ধরে সেই অটোচালকের স্ত্রী-সন্তানদের নাজিরের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতে দেখা যায় বলে জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা।

নাজির গফুর সিন্ডিকেটের ৩০ হাজার ইয়াবা আটকের ঘটনা জানাজানি হলে গফুরের উপর দায় চাপিয়ে দেন সুচতুর নাজির। ওই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় গফুরের নাম আসলেও বারাবরেই নাজির রয়ে যান আড়ালে। লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে বীরদর্পে নাজির ঘুরে বেড়ালেও আত্মগোপনে চলে যায় গফুর।

স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উঠান বৈঠকের সময়ও নাজিরকে দেখা যায় প্রথম সারিতে। নিজেকে মাদক বিরোধী প্রমাণ করতে বিভিন্ন সাংবাদিকদের কাছে মাদক ব্যবসায়ীদের নাম ঠিকানাও সরবরাহ করেন এই ইয়াবা গডফাদার নাজির। হয়েছেন মসজিদ কমিটির সভাপতিও। আবার এলাকার অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেন মোটা অংকের মাসোয়ারাও।

গত মঙ্গলবার ও বুধবার নয়াপাড়া এলাকায় গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, মাদক ব্যবসায়ী আর স্থানীয় ও বহিরাগত ক্রেতাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ তারা। তাদের প্রশ্ন, নাজিরসহ অন্য ব্যবসায়ীরা চিহ্নিত হওয়ার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না। প্রশাসন সবকিছু জানলেও এলাকায় কীভাবে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে?

স্থানীয়দের অভিযোগ, আগে গোপনে বিক্রি হলেও দুই বছর ধরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে এলাকার মসজিদের সামনে। স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি এই জায়গায় মাদক কিনতে আসেন বহিরাগতরাও। এরা রাস্তা ও গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ইভ টিজিংও করে নারীসহ স্কুলগামীদের।

স্থানীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, সম্প্রতি নাজিরের বাড়ি থেকে কমপক্ষে তিনটি বড় বড় চালান গিয়েছে জেলার বাহিরে। কিছুদিন আগেও খরুলিয়া নয়াপাড়ার ওই বাড়ির উঠানে একটি নোহার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেটিতে করে ৩০ হাজারেরও অধিক একটি বিশাল চালান চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যায়।

এব্যাপারে নাজিরের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বড় বড় পুলিশ অফিসার, সাংবাদিক, প্রাশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন বলে দাবী করে বলেন- আমার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে লাভ নেই। রামু থানাকে আমার ব্যবস্থা করা আছে। এগুলো আপনাদের অনুসন্ধানের আগেই চার্জশীট গঠন করিয়ে নিয়েছি পুলিশকে দিয়ে। নতুন করে আমাদের মামলায় ঢুকানোর কোনো রাস্তা খোলা রাখি নাই।

এবিষয়ে জানতে মামলার তদন্তে থাকা কর্মকর্তা রামু থানার এস.আই মো. মঞ্জু বলেন, যেখানে চার্জশিট হয়নি, সেখানে মামলা থেকে বাদ দেয়ার কথাটি হাস্যকর। তদন্ত এখনও চলমান রয়েছে। এর মধ্যে কেউ যদি গুজব ছড়াই তার দায়ভার পুলিশ নেবেনা।

তিনি আরোও বলেন, স্বীকারোক্তি বা অন্যান্য সূত্র ধরে যাদের নাম এসেছে এক এক করে সবার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রমাণ পেলে এই মামলায় নথিভুক্ত করা হবে।

সম্পর্কিত পোস্ট