মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের কয়েক জেলার কয়েকশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ বৃষ্টি ও ঢল অব্যাহত থাকলে এসব জেলায় বন্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনও বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ পানির মধ্যেই বসবাস করছে।
আবহাওয়া অধিদফতর এবং বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও দেশজুড়ে আগামী পাঁচ দিন বৃষ্টিপাত ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে বন্যা শুরু হয়ে অন্তত ১০ দিন স্থায়ী হতে পারে।
জানা গেছে, দেশের বেশ কয়েকটি এলাকা টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে সেসব অঞ্চলের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে মীরসরাই উপজেলার ১২নং খইয়াছরা ইউনিয়নের ফেনাপুনি গ্রামের প্রায় ১২০ পরিবার চরম দুর্ভোগে রয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, মীরসরাই সদর, মীরসরাই পৌরসভা, খইয়াছরা, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গর্তও দেখা গেছে।
খইয়াছরা ইউনিয়নের ফেনাপুনি এলাকার বাসিন্দা এস এম হাসান বলেন, এই গ্রামে আর থাকতে মন চাইছে না। বৃষ্টি হলে বসতঘরে পানি ঢুকে যায়।
উপজেলার ১৫নং ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ জানান, পাহাড়ি ঢলে মাইজগাঁও, খাজুরিয়া, বড়কমলদহ, গাছবাড়িয়া গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ইউনিয়নের হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া সড়ক, নিজামপুর রেল স্টেশন সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রঘুনাথ নাহা বলেন, যে বৃষ্টি হয়েছে আশা করি ফসলের তেমন ক্ষতি হবে না। কারণ, পানি নিচের দিকে নেমে যাবে। যদি বৃষ্টি কয়েকদিন অব্যাহত থাকে তাহলে রোপা আমনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, রাতভর টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৩৬টি গ্রাম লন্ডভন্ড এবং তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পৌরসভার দেড় শতাধিক পুকুরের ওপর দিয়ে তিন ফুট উঁচু পাহাড়ি ঢল প্লাবিত হয়েছে। দুই হাজার একর সবজিক্ষেত ডুবে গেছে। বাঁশখালী পৌরসভা, পুঁইছড়ি, শীলকূপ, চাম্বল, শেখেরখীল, বৈলছড়ি ও কালীপুর ইউনিয়নের ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গে
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া ও হালুয়াঘাট উপজেলায় টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে ১৬ ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নেতাই পাড়ের খেটে খাওয়া মানুষজন।
স্থানীয়রা জানান, নেতাই নদীর বেড়িবাঁধ ৪/৫ জায়গায় ভেঙে গেছে। এতে ওই উপজেলার গামারিতলা, দক্ষিণ মাইজপাড়া, ঘোষগাঁও, বাঘবেড়, সদরসহ পাঁচটি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাশিকুজ্জামান জানান, পাহাড়ি ঢলে হঠাৎ নির্মাণাধীন নেতাই নদীর বাঁধের ৪/৫টি স্থানে ভাঙন হয়ে পানি ডুকে পড়ে পাঁচ ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। বন্যার পানি মানুষের ঘরবাড়ি এবং মাছের খামারে ঢুকে পড়েছে।
হালুয়াঘাটের ইউএনও রেজাউল করিম জানান, প্রতিবারের মতো এবারও বর্ষার শুরুতেই পাহাড়ি ঢলে এবং কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ১১টি ইউনিয়নে বন্যা হয়েছে। পানি মানুষের ঘরবাড়ি এবং মাছের খামারে ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি মানুষকে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়ার সব প্রস্তুতি চলছে।
কয়েকদিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলার নিম্নাঞ্চল গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ।
এদিকে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আঘাত হেনেছে ধলাই তীরবর্তী চাঁনপুর গ্রামে। আকস্মিক ঢলে গ্রামের ১০টি পরিবারের বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তারা পার্শ্ববর্তী ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ১৯০টি পরিবার।
কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও সুমন আচার্য বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের হাতে খাবার দেওয়া হয়েছে। যারা বাড়িঘর হারিয়েছেন তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভাঙন রোধেও কাজ করে যাচ্ছি। গ্রামটিকে রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডেও চিঠি পাঠিয়েছি। তাছাড়া, পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্গত এলাকার লোকজনের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে এদের অববাহিকায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে কিংবা দ্বিতীয় সপ্তাহে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরইমধ্যে তিস্তার পানি হ্রাস-বৃদ্ধির চক্রে ভাঙনে রুদ্র রূপ নিয়েছে। তীব্র ভাঙনে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা। ভিটে হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে একের পর এক পরিবার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে এই দুই নদ-নদী অববাহিকায় একটি স্বল্পমেয়াদি বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, দুই মাসের বেশি সময় আগে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাঁধ ভাঙায় নদীর পানি ঢুকে সাতক্ষীরার প্রতাপনগরের ২৫ হাজার মানুষ আজও পানিবন্দি হয়ে আছেন।