কিশোরীকে বিয়ে করে বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় বিয়ের পরদিনই চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারকে (৬০) তালাক দেওয়া কিশোরীকে (১৪) দুই মাসে তিনবার জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবশেষ প্রেমিকের সঙ্গে দেওয়া বিয়েটিও বাল্যবিয়ে। বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে কিশোরী।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাউফল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন ও বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন। উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়নের আলোচিত এ ঘটনার একদিন পরই কিশোরীর বাবা ও কাজি সাদেক হোসেন গা ঢাকা দিয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৮ মে প্রতিবেশী সোহেল আকনের সঙ্গে কিশোরীকে জোরপূর্বক বিয়ে দেন বাবা-মা। ২৪ জুন কিশোরী তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যান।
এ ঘটনার সালিশ করতে এসে কিশোরীকে দেখে পছন্দ হওয়ায় সোহেল আকনের সঙ্গে তালাক করিয়ে ২৫ জুন রাতে কিশোরীকে জোরপূর্বক বিয়ে করেন কনকদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার। পরপর বাল্যবিয়ে দেওয়ার পরও টনক নড়েনি স্থানীয় প্রশাসন কিংবা কোনও সমাজকর্মীর। এ খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে সমালোচনার মুখে প্রভাব খাটিয়ে কাজি ডেকে কিশোরীকে ২৬ জুন তালাক দিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বাল্যবিয়ে দিয়ে দেন চেয়ারম্যান।
বাল্যবিয়ের বিষয়ে কিশোরীর বাবা বলেন, প্রথমে ১৮ মে বাল্যবিয়ে দেওয়াটা আমার ঠিক হয়নি।কিন্তু চেয়ারম্যানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইনি। চেয়ারম্যান জোর করে বিয়ে করেছেন। আমার কোনও উপায় ছিল না। সোহেল আকনের সঙ্গে বিয়ের সময় মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রেখেছিলাম। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সোহেল আকনের পরিবারের সঙ্গে এ নিয়ে ঝামেলা চলছিল।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীকে দুই মাসে তিনবার বাল্যবিয়ে কীভাবে দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নিকাহ রেজিস্টার সাদেক হোসেন বলেন, তিনবারই বাল্যবিয়ে হয়েছে; এটি ঠিক। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যে জন্মসনদ দেওয়া হয়েছে; তাতে মেয়ের জন্ম সাল ২০০৩ সালের ১১ এপ্রিল উল্লেখ করা হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায়, ১৮ বছর দুই মাস ১৫ দিন বয়স তার। তা দেখেই আমি কাবিন করেছি। জন্মসনদে ১৮ বছর না হলে কাবিন ও বিয়ে দিতাম না। এছাড়া বিয়েতে মেয়ের বাবা-চাচাসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকায় বিষয়টি যাচাই করিনি।
এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে কনকদিয়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরিমল চন্দ্র বলেন, ওই কিশোরী আমার প্রতিষ্ঠানের অষ্টম শ্রেণির নিয়মিত শিক্ষার্থী। স্কুলে তার যে জন্মসনদ রয়েছে তাতে উল্লেখ আছে, ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল তার জন্ম। সে অনুযায়ী তার বয়স ১৪ বছর দুই মাস ১৫ দিন। চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারের সঙ্গে তার বিয়ের বিষয়টি লোকমুখে শুনে অবাক হয়েছি। আমি বিষয়টি অনেক পরে শুনেছি। আগে শুনলে প্রতিবাদ করতাম।
কনকদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলেন, ১৪ বছরের কিশোরীকে দুই মাসে তিনজনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া খুবই দুঃখজনক। যেখানে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব; সেখানে চেয়ারম্যান বাল্যবিয়ে করা দুঃখজনক। সঠিক বিচার না হলে এ ধরনের অপরাধ আরও বৃদ্ধি পাবে।
কিশোরীকে তিনজনের সঙ্গে জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে বাউফল থানার ওসি আল মামুন বলেন, বাল্যবিয়ের খবর আমাদের কাছে এলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। তবে ওই কিশোরীর বিয়ের খবরটি আমাদের কাছে দেরিতে এসেছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউএনও মো. জাকির হোসেন বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে শুধু আমরাই কাজ করি বিষয়টি এমন নয়। থানার ওসি, সমাজসেবা কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংগঠনও কাজ করে। আমাদের কাছে বাল্যবিয়ের খবর এলে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিই। কিশোরীর বিয়ের খবর আমাদের কাছে দেরিতে এসেছে। যখন খবর এসেছে তখন পদক্ষেপ নিয়েছি। বাল্যবিয়ের সত্যতা পেয়ে স্থানীয় মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এখন তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
পটুয়াখালী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক শিলা রানী দাস বলেন, মেয়ের বয়স যেহেতু ১৮ বছর হয়নি সেহেতু বাল্যবিয়ে দেওয়া অপরাধ হয়েছে। মেয়ের বাবা প্রথমে অপরাধ করেছেন, এরপর চেয়ারম্যান অপরাধ করেছেন। এরপর প্রেমিককে বিয়ে করা আরেকটি অপরাধ হয়েছে। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা হয়েছে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে মেয়ের বাবা এবং কাজির বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা। একই সঙ্গে মেয়ের বয়স যতদিন ১৮ বছর পূর্ণ না হবে ততদিন বিয়ে কার্যকর হবে না। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত মেয়েকে সেফহোমে রাখতে হবে। এ বিষয় দেখাশোনা করে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর।
জানতে চাইলে জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শাহিদা বেগম বলেন, বিয়ের সময় কোনও মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম হলে তা বাল্যবিয়ের আওতায় পড়ে। ওই কিশোরীর বিয়ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ আছে।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ওই কিশোরীকে বাল্যবিয়ে দেওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরই মধ্যে কিশোরীকে বিয়ে করায় চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সোমবার (২৮ জুন) রাতে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার সালিশ করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে বিয়ে করেন। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ (৪) (ঘ) ধারার অপরাধ সংঘটিত করায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।
বাল্যবিয়ের বিষয়ে কিশোরী বলেন, ‘বর্তমান স্বামীর সঙ্গে আমার তিন বছরের প্রেম ছিল। বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে মিথ্যা মামলার ভয়ভীতি দেখানো হয়। এতে কয়েক মাস তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ ছিল। ২৪ জুন আমি তার সঙ্গে পালিয়ে যাই। পরে বাবা বিষয়টি চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারকে জানান। চেয়ারম্যান আমাকে অন্য রুমে ডেকে নিয়ে বলেন, তোমার প্রেমিকের টাকা-পয়সা নেই। তুমি সেখানে সুখী হতে পারবা না। বরং আমাকে বিয়ে করলে সুখী হবে। আমি তার কথায় রাজি হইনি। ভেবেছিলাম দুষ্টুমি করছেন। আগে যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাকে তালাক দিতে কাজি ডাকলেন চেয়ারম্যান। পরে চেয়ারম্যান আমাকে বিয়ে করেন। এরপর চেয়ারম্যানকে তালাক দিয়ে প্রেমিককে বিয়ে করি। বাল্যবিয়ে হলেও আমি এখন ভালো আছি।’