টানা তিন দফা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি মামলা ও গ্রেফতারে নেতাকর্মীদের নাজেহাল অবস্থা- সবমিলে দলটি বর্তমানে চরম দুঃসময় পার করছে।
একই সঙ্গে এই দুঃসময়ে পাশে নেই দলটির দুই কাণ্ডারি- চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ অবস্থায় বর্তমান সংকট কাটিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে ঘুরে দাঁড়ানোই বিএনপির এখন মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন পরিস্থিতিতেই আজ উদযাপিত হচ্ছে বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের এই দিনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। দলীয় কার্যালয়ে আজ ভোরে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির নেতাকর্মীরা শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন। বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা হবে। সারা দেশে সব ইউনিট বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কাল সোমবার রাজধানীসহ সারা দেশে র্যালি করবে বিএনপি। এজন্য ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতিও নিয়েছে দলটি। আশপাশের জেলা থেকে ঢাকার র্যালিতে অংশ নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, নেতাকর্মীদের মাঝে আস্থা ও মনোবল ফিরিয়ে আনতে সঠিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীদের সামনে এনে দ্রুত দল পুনর্গঠনে হাত দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। তাদের মতে, প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয়ে পড়ে দলটি। কিন্তু বারবারই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এবারও দলটি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা তাদের। কারণ এদেশের লাখ লাখ তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থক জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমে উচিত দলকে সুসংহত করা। জিয়াউর রহমানের আদর্শে সবাইকে উজ্জীবিত করা এবং ওই যৌক্তিকতায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করা। দলকে সংঘবদ্ধ করা। বিএনপির কিছু ভুলও রয়েছে উল্লেখ করে দলটির এই নীতিনির্ধারক বলেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে থাকা বিএনপির মারাত্মক ভুল। এছাড়া একতাবদ্ধ না হওয়া এবং জনগণকে সম্পৃক্ত না করাটাও বিএনপির রাজনীতির নেতিবাচক দিক। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপি একা এ অবস্থা থেকে দেশকে বের করে আনতে পারবে না। সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সর্বদলীয় ঐক্যের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে যৌথ নেতৃত্বে চলছে বিএনপি। তিনি লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করলেও তা সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা একপ্রকার অন্ধকারে। এ সময়ে দলের তরফে বড় কোনো সিদ্ধান্ত যেমন আসেনি, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিকে করা যায়নি জোরালো। কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, জনসমর্থন তুঙ্গে থাকলেও দশকজুড়ে টানা বিপর্যয় এবং নানামুখী সাংগঠনিক দুর্বলতায় তা সম্ভব হয়নি। সবমিলে আন্দোলনে ব্যর্থতা ও মামলার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, স্বাধীনতার পক্ষের এ দলটি যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করায় রাজনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। যে কোনো বিষয়ে প্রতিপক্ষ বারবার জামায়াতকে সামনে এনে বিএনপিকে ধরাশায়ী করছে। দেশের জনগণের বড় একটি অংশও বিএনপির এই কৌশল পছন্দ করছে না। তাই এখন সময় এসেছে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ত্যাগ করে বিএনপিকে আপন শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। তাহলে দেশের সুশীলসমাজসহ বড় একটি অংশের সমর্থন বিএনপি পাবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি দেশের পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। দলটির অতীত অনেক গৌরবোজ্জ্বল। নানা সময় দলটি বিপর্যয়ে পড়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একাদশ নির্বাচনের পর বিএনপি আবারও নতুন করে সংকটে পড়ছে, এতে সন্দেহ নেই। এ সংকট থেকে উত্তরণে বিএনপিকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। যোগ্য ও ত্যাগীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনতে হবে। নতুন নেতৃত্বকে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, টানা তিন দফায় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। স্বাভাবিকভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিএনপির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অবশ্য মামলা-হামলার কারণে নেতাকর্মীরা বেকায়দায় রয়েছেন। তিনি বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, তা চেষ্টা করছে বিএনপি। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দলটির জন্য ভালো তো বটেই, দেশের জন্যও ভালো। তবে এ সময়টা কবে আসবে, বলা কঠিন। এটাও ঠিক, জামায়াতকে ত্যাগ করতে পারলে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না।
এদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে মনেপ্রাণে কাজ করার জন্য দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বর্তমান দুঃসময়ে জনগণকে সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। দেশ আজ দুঃশাসনকবলিত। আইন, বিচার, প্রশাসনকে সরকার কব্জার মধ্যে রাখার চেষ্টায় মরিয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেআইনি কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে সমাজে দেখা দিয়েছে বিপজ্জনক বিশৃঙ্খলা। খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অনাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সরকার যেখানে জনগণের প্রতিপক্ষ, সেখানে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা থাকতে পারে না। সুতরাং জনগণের নিরাপত্তাবিধানের জন্যই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন বেগবান করতে হবে। তিনি প্রতিহিংসার শিকার। কারণ তিনিই গণতন্ত্রের প্রতীক এবং জনগণের নাগরিক ও বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে প্রধান কণ্ঠস্বর। পাশাপাশি দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাণীতে বিএনপি মহাসচিব দেশবাসীকে বিএনপির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য উদাত্ত আহ্বানও জানান।
যুগান্তর