শাহীন আবদুর রহমান:
করোনা বা কভিড-১৯ একটি শ্বসনতন্ত্রের রোগ যাতে মূলত ফুসফুস আক্রান্ত হয়। করোনা সাধারণত ড্রপলেট, ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও নিবিড় সান্নিধ্যের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মাঝে ছড়িয়ে যায়। মলের মাধ্যমে এর ছড়িয়ে যাবার ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি।
ভাইরাস জনিত হেমোরেজিক রোগ (যেমন- ইবোলা, মারবার্গ জ্বর), কলেরা ইত্যাদি রোগ ব্যাতিত সাধারণ মৃতদেহ সংক্রামক নয়। প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জাতে মৃতদেহের ফুসফুস যদি ময়নাতদন্তের সময় অসতর্ক ভাবে হ্যান্ডেল করা হয় তবে ফুসফুস থেকে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে।
করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে, বাড়িতে বা অন্য যেকোন জায়গায় মৃত্যুবরণ করতে পারেন। এখনো পর্যন্ত করোনায় মৃতদেহ থেকে কেউ সংক্রমিত হবার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তথাপি করোনা সন্দেহজনক (Suspected), সম্ভাব্য (Probable) ও সুনিশ্চিত (Confirmed) বা পরীক্ষায় প্রমাণিত রোগীর মৃতদেহ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সমস্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
মৃতদেহ প্রস্তুতকরণ ও মোড়কীকরণ
* সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ মৃতদেহের সংস্পর্শে আসার আগে ও পরে সঠিকভাবে হাত পরিস্কার করা, মৃতদেহের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করা এবং উপযুক্ত পিপিই, যেমনঃ গাউন ও গ্লাভস পরিধান করতে হবে। যদি মৃতদেহের বিভিন্ন রস ছিটকে আসার বা লেগে যাবার সম্ভাবনা থাকে তবে ফেস শীল্ড, গগলস এবং মেডিকেল মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
* মৃতদেহ থেকে সমস্ত লাইন বা টিউব, ক্যাথেটার ইত্যাদি খুলে ফেলতে হবে।
* যতদূর সম্ভব মৃতদেহ নাড়াচাড়া বা ঘাটাঘাটি সীমিত করতে হবে।
* মৃতদেহ জীবাণুমুক্ত করার কোন প্রয়োজন নেই।
* বিভিন্ন পথ থেকে নিসৃত রস সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। সাধারণত বডি ব্যাগ ব্যাবহার করার কোন প্রয়োজন নেই। তবে অতিমাত্রায় রস নিসৃত হলে সেক্ষেত্রে ব্যাবহার করা যেতে পারে।
* মৃতদেহ পরিবহনের জন্য কোন বিশেষ বাহন বা সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই।
বাড়িতে বা লাশঘরে প্রস্তুতি
* মৃতদেহ পরিস্কার করা বা গোসল করানো, চুল আঁচড়ানো, নখ কাটা বে শেভ করার ক্ষেত্রে পানি রোধী গ্লাভস, পানিরোধী গাউন, মেডিকেল মাস্ক ও চোখের সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে।
* পরিবারের সদস্যরা স্পর্শ না করে শুধুমাত্র দেখার ইচ্ছা পোষণ করলে সেক্ষেত্রে আগে ও পরে হাত ধোয়া, মেডিকেল মাস্ক পরা ইত্যাদি সুরক্ষার মাধ্যমে তা করতে পারেন।
* Embalming বা সুগন্ধিদ্রব্য ইত্যাদির মাধ্যমে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা করোনার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ।
* ষাটোর্ধ ব্যক্তিগণ বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন লোকজন মৃতদেহ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট হতে পারবেন না।
সমাহিত করা বা কবর দেয়া
* করোনায় মৃতদেহ সমাহিত করতে বা পুড়িয়ে ফেলতে কোন বাধা নেই। এক্ষেত্রেও স্বজনেরা স্পর্শ না করে শুধুমাত্র দেখার ইচ্ছা পোষণ করলে সেক্ষেত্রে আগে ও পরে হাত ধোয়া, মেডিকেল মাস্ক পরা ইত্যাদি সুরক্ষার মাধ্যমে তা করতে পারেন।
* কবরস্থ করা বা পুড়িয়ে ফেলায় নিয়োজিত ব্যক্তিগণ গ্লাভস পরিধান করতে হবে এবং সমাহিত করার পর গ্লাভস খুলে সাবান ও পানি দিয়ে নিয়মমতো হাত পরিস্কার করে ফেলতে হবে।
* জানাযায়, সমাহিত করায় বা যেকোন ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সর্বনিম্ন সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করা বাঞ্চনীয়।
ময়নাতদন্ত
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বা IEDCR এর নির্দেশনা অনুসারে করোনায় মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে একান্ত আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলে সেক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে তা করতে হবে।
পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতা
* মৃতদেহের অবস্থান বা প্রস্তুতিকরণ পৃষ্ঠতল প্রথমে ভালভাবে সাবান বা ডিটারজেন্ট পাউডার ও পানি দিয়ে পরিস্কার করতে হবে।
* এরপর ০.১% হাইপোক্লোরাইট বা ব্লিচিং পাউডার দ্রবণ বা ৭০% ইথানল দিয়ে এক মিনিট ধরে পরিস্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ গ্লাভস, চোখের সুরক্ষা সরঞ্জাম ও মেডিকেল মাস্ক ব্যবহার করবেন।
পরিধেয় কাপড়চোপড়
* মৃতদেহের ব্যবহৃত জিনিসপত্র পুড়িয়ে ফেলা বা পরিত্যক্ত করার প্রয়োজন নেই। তবে এসব জিনিস গ্লাভস পরিধান করে নাড়াচাড়া করতে হবে। প্রথমে ভালভাবে সাবান বা ডিটারজেন্ট পাউডার ও পানি দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। এরপর ০.১% হাইপোক্লোরাইট বা ব্লিচিং পাউডার দ্রবণ বা ৭০% ইথানল দিয়ে এক মিনিট ধরে পরিস্কার করতে হবে।
* ব্যবহৃত কাপড়চোপড় বা কাপড়ের জিনিসপত্র ৬০°-৯০° সে. তাপমাত্রার পানি ও লন্ড্রি ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে মেশিনে ধুয়ে ফেলতে হবে। যদি মেশিনে ধোয়া সম্ভব না হয় তবে বড় ড্রামে একই তাপমাত্রায় সাবান বা ডিটারজেন্ট পাউডার এ একটা কাঠির মাধ্যমে নেড়ে পরিস্কার করতে হবে যাতে পানি ছিটকে না পড়ে। এরপর ড্রামের পানি ফেলে দিয়ে কাপড়গুলো ০.০৫% ক্লোরিন দ্রবণে প্রায় ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতে হবে।
মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক
ডা.শাহীন আব্দুর রহমান
আবাসিক ও চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরএমও) এবং বিশেষায়িত জরুরী বিভাগের প্রধান, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল।