অফিস ভবনে যৌন হয়রানি, বিভিন্ন সময়ে অফিসে মদের আড্ডা বসানোর অভিযোগে শিল্পকলা একাডেমির উপ-পরিচালক শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসাদচরণ প্রমাণিত হওয়ার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের প্রায় একমাস হতে চললেও তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিবেদনে বিভাগীয় মামলা করতে বলা হলেও শিল্পকলার মহাপরিচালককে এখন পর্যন্ত কোনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং অভিযুক্ত কর্মকর্তা শনিবার (১৭ জুলাই ২০২১) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কে গোপনে আপনাকে কী অভিযোগ করলো সেটা দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না।’
তার বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা প্রশ্নে উল্টো তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ দিয়েছি।’
যদিও খোদ পরিষদের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে এখনও পরিষ্কার কোন তথ্য জানেন না। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এই শহীদুল ইসলাম মহাপরিচালকের একান্ত কাছের লোক হওয়ায় অর্থ আত্মসাৎসহ আরও অনেক ধরনের অভিযোগ থাকার পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উপ-পরিচালক, অর্থ (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে কর্মরত আছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অশ্লীলতা ও বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ আনেন সাধারণ কর্মচারিরা। এ বছর ২ মার্চের এই অভিযোগের ভিত্তিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ফাহিমুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৫ অভিযোগে তদন্ত, মিলেছে প্রমাণ
শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৫টি বিষয়ে তদন্ত করে কমিটি। এতে পাঁচটি বিষয়ে তদন্তে সুপারিশের পরামর্শ আসে কমিটির পক্ষ থেকে। সেসব হচ্ছে- বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অর্থ তছরুপের তথ্য পাওয়া যায় কিনা, অর্থ বছর শেষে উদ্বৃত্ত অর্থ ভুয়া ভাউচার তৈরির মাধ্যমে আত্মসাৎ, টেন্ডারবিহীনভাবে কোটি কাটি টাকা তিনি তার নিজের নামে ও তার সিন্ডিকেটের নামে উত্তোলন করেছেন কিনা, ৪ জানুয়ারি অফিস চলাকালে নারী কর্মীদের সামনে উলঙ্গ হয়ে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করেছেন কিনা, প্রায়শ অফিসে মদের আসব বসানো হয় কিনা?
অশ্লীলতা ও যৌন হয়রানির অভিযোগ
কস্টিটিউম ডিজাইনার এক নারী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, ৪ জানুয়ারি তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করার এক পর্যায়ে শহিদুল ইসলাম উলঙ্গ হয়ে অশালীন আচরণ করতে থাকেন। এসময় আরও কারা উপস্থিত ছিলেন তিনি সেটি বিস্তারিত জানান এবং অভিযোগ করেন যে, সব সময়ই শহিদুল ইসলাম দম্ভ দেখিয়ে বলে আসছেন তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। কেন করতে পারবে না বলে মনে করেন জানতে চাইলে একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী বলেন, উনি ডিজির লোক। উনি আর্থিকভাবেও দুর্নীতি করে নানা সময় পার পেয়ে গেছেন।
উল্লেখ্য, হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক যে কোনও ধরনের নির্যাতনই যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, যে কোনও ধরনের অশালীন চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। রায়ে বলা হয়, কোনও নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যে কোনও ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন, অশালীন চিত্র, দেয়াল লিখন, আপত্তিকর কিছু করাও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে।
তদন্তের সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ
তদন্ত শেষে কমিটি ২৭ জুন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত ৪ জানুয়ারি অফিস চলার সময়ে একাডেমির নারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সামনে উলঙ্গ হয়ে বিভিন্ন অশোভন অঙ্গভঙ্গী করার বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত। বিভিন্নসময়ে অফিসে মদের আড্ডা আয়োজন করার বিষয়টিও প্রমাণিত। এই দুটি অভিযোগেই বাংলাদেশশিল্পকলা একাডেমি (কর্মকর্তাও কর্মচারি) প্রবিধানমালা ১৯৯২ এর ২(ক) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একাডেমিতে সুস্থ কাজের পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা আবশ্যক। এছাড়া সরকারি অফিসে মদ্যপানের বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ১১ ধারা মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থ তছরুপ করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে শিল্পকলা অধিকতর তদন্তের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এছাড়াও ৬ সুপারিশের মধ্যে অন্যতম হলো যে- সকল ক্ষেত্রে বিধিবহির্ভূতভাবে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে তা প্রত্যাহার এবং নিয়মানুগ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে সকল ক্ষেত্রে প্রবিধিমালা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধিবিধান যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গত ৫ বছরের অ-নিরীক্ষিত হিসাব ‘বিশেষ নিরীক্ষা’র জন্য বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়কে অনুরোধ করার সুপারিশও করা হয়। সরকারি অর্থের অপচয় রোধ ও তছরুপের সুযোগ রোধে কেন্দ্রীয়ভাবে এক জায়গা থেকে কেনার ব্যবস্থা করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
এদিকে ১৫ জুলাই সিনিয়র সহকারী সচিব নাজমা বেগমের সাক্ষরকৃত চিঠিতে তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো উল্লেখ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
একই দিনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাজমা বেগমের সাক্ষরকৃত আরেকটি নির্দেশনায় জানানো হয় শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ দুটি অভিযোগই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) প্রবিধানমালা, ১৯৯২ এর ২(ক) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায়, জনাব শহিদুল ইসলাম উপপরিচালক অর্থ (চলতি দায়িত্ব) এবং রুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একাডেমিতে সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি (কর্মকর্তা ও কর্মচারি) প্রবিধানমালা, ১৯৯২ এর ২(ক) বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা রুজু করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
তদন্তে প্রমাণিত, তারপর?
নিয়মানুযায়ী তদন্ত করে প্রতিবেদন সুপারিশসহ মহাপরিচালকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ২৭ জুন জমা দেওয়া সেই প্রতিবেদনের পরবর্তী ধাপ আসলে কী আর প্রায় এক মাসে তা দৃশ্যমান হলো না কেন প্রশ্নে মন্ত্রনালয়ের যুগ্মসচিব অসীম কুমার দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা যেটুকু তদন্ত করেছি, সাক্ষ্য নিয়েছি এবং যা প্রতিবেদন সেটি শিল্পকলা একাডেমিতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পরের ব্যবস্থা মহাপরিচালক নিবেন। আপনারা জানেন শিল্পকলা একাডেমি সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর পরিচালনার কিছু নিয়ম আছে। সেটিতো মানতেই হয়। তবে পরিচালনা পর্ষদ এখানে ভূমিকা রাখতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এদিকে পরিষদের সদস্য রামেন্দু মজুমদার বলেন এ বিষয়ে একবার পরিষদকে অবহিত করা হলেও পরবর্তীকালে তদন্ত বা তদন্ত প্রতিবেদন আকারে কিছু পরিষদে হাজির করা হয়নি।
এদিকে নিজের ১৬ বছরের চাকরি জীবনে কেউ তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনতে পারেননি বলে দাবি করে অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েকজন ব্যক্তি গোপনে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেই কিছু প্রমাণ হয়ে যায় না। বেশিরভাগ সহকর্মী তার পক্ষে কথা বলবেন বলেও দাবি করেন তিনি।
যদিও সাক্ষ্য দেওয়া সহকর্মীদের বাদে অন্য একাধিক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে তার দাবির সত্যতা মেলেনি। তারা বলছেন, শহিদুল মহাপরিচালকের লোক পরিচয় দিয়ে নানা দুর্নীতি করছে। কেন এই দুই তিনজন আপনার বিরুদ্ধে বলছেন প্রশ্নের জবাবে শহিদুল ইসলাম বলেন, এখানে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিহিংসা কাজ করে। আমরা জেলা থেকে ঢাকায় এসেছি এটা অনেকের সহ্য হয় না।