কক্সবাজারের টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুর এবিপিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত চাঞ্চল্যকর মেজর (অবঃ) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান স্বাক্ষী আবদুল হামিদ, তার ষাটোর্ধ বৃদ্ধা মা, ভাই, বোন সহ পরিবারের ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মিথ্যা মামলা রেকর্ডের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৩ মে শামলাপুর পুরানপাড়ার মৃত আবদু শুক্কুরের ছেলে ছৈয়দ করিমকে বাদী বানিয়ে মিথ্যা কাউন্টার মামলাটি (টেকনাফ থানার মামলা নং-৬১, জিআর-৩৭৮) রেকর্ড করেন টেকনাফ থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান। আর মামলার তদন্তকারী দেয়া হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর নুর মোহাম্মদকে।
দায়েরকৃত মিথ্যা মামলার শিকার আবদুল হামিদ, তার ষাটোর্ধ বৃদ্ধা মা মেহের খাতুন ,ভাই সাংবাদিক জাফর আলম, আবদুল্লাহ, বোন নুরুন্নাহার, জাফরের স্ত্রী তসলিমা সোলতানা নিশী সহ পরিবারের ৬ সদস্য গত ১ জুন কক্সবাজার অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পন করে জামিনের আবেদন জানান। বিজ্ঞ আদালত তাদের জামিন আবেদন মঞ্জুর করে জামিনে মুক্তি দেন।
জানা গেছে, টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুরানপাড়া গ্রামে ২৯ এপ্রিল ইফতার চলাকালিন সময় বসতবাড়ীতে ডুকে জাতীয় দৈনিক আজকের সংবাদ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক জাফর আলমের বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী তসলিমা সোলতানা নিশীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করা হয়।
ঘটনার সময় বাড়ীতে কোন পুরুষ সদস্য না থাকার সুযোগে বাহারছড়া শামলাপুর পুরানপাড়ার মৃত আবদু শুক্কুরের ছেলে ছৈয়দ করিম প্রকাশ ডেবিট এর নেতৃত্বে ১০/১২ জন দুর্বৃত্ত দা, ছুরি, লাঠি ও কিরিচ এলোপাতাড়ি হামলা চালায়।
আহতদের উদ্ধার করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এঘটনায় সাংবাদিক জাফর আলম বাদী হয়ে ছৈয়দ করিম প্রকাশ ডেবিটকে প্রধান আসামী করে ৭ জনের বিরুদ্ধে গত ৮ মে টেকনাফ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামীরা হলেন- ছৈয়দ করিম প্রকাশ ডেবিট, বেলাল হোসেন,মো. জয়নাল, মো. জাগির হোসেন,মরিয়ম খাতুন, পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হাবিব উল্লাহর স্ত্রী খালেদা বেগম, মুন্নী আকতারসহ আরও অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জন। কিন্ত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাহার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর নুর মোহাম্মদ রহস্যজনক আচরণ করে কোন আসামী গ্রেফতার না করায় আসামীরাও বেপরোয়া হয়ে পড়ে। উল্টো আক্রান্ত জাফর আলমের পরিবারকে হয়রানী করার চক আকেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
সাংবাদিক জাফর আলমের বড় ভাই আবদুল হাকিম হচ্ছে মেজর (অবঃ) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান স্বাক্ষী। যিনি ঘটনাস্থলের পাশেই ভ্রাম্যমান দোকানদার ছিলেন। সেই থেকেই পুলিশ তাদের পরিবারের উপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন বলে অভিযোগ।
এদিকে, টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুরে আলোচিত মেজর (অবঃ) সিনহা মো.রাশেদ হত্যা মামলার অন্যতম স্বাক্ষী আবদুল হামিদ ও সাংবাদিক জাফর আলমের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা রেকর্ড করে হয়রানী করার ঘটনায় এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর এপিবিএন তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা নিহত হন। ৫ আগস্ট মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে পুলিশের নয় সদস্যকে আসামি করে কক্সবাজার আদালতে হত্যা মামলা করেন।
আদালত বাদীর এজাহারটিকে সরাসরি হত্যা মামলা হিসেবে রুজু করার জন্য টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) আদেশ দেন। ওইদিন রাতে আদালতের আদেশনামা টেকনাফ থানায় পৌঁছে এবং নয় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। পরের দিন অভিযুক্ত সাত আসামি- প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দদুলাল রক্ষিত, লিটন মিয়া, সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
টেকনাফ থানার প্রত্যাহার হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া ক্যাম্পের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, টেকনাফ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন জন ও স্থানীয় তিন জনসহ বাকি ১৪ আসামি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার কারাগারে বন্দি আছেন।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব সিনিয়র এএসপি খায়রুল ইসলাম কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেন।
এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় অন্যতম স্বাক্ষী হচ্ছে বাহারছড়া শামলাপুর পুরানপাড়ার মৃত ফজলুল করিমের ছেলে আবদুল হামিদ।
ওই মানলার অন্যতম স্বাক্ষী আবদুল হামিদের বৃদ্ধা মা মেহের খাতুন ও ছোট ভাই সাংবাদিক জাফর আলমের স্ত্রী তসলিমা সোলতানা নিশীকে গত ২৯ এপ্রিল ইফতারের সময় কুপিয়ে আহত করে স্থানীয় ইয়াবা ব্যবসায়ী চক্র। ঘটনার সময় কোন পুরুষ সদস্য বাড়ীতে না থাকার সুযোগে ইফতারের সময় এঘটনাট সংগঠিত করা নিয়ে এলাকায় চাপাক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনায় সাংবাদিক জাফর আলম বাদী হয়ে গত ৮ মে টেকনাফ থানায় ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। টেকনাফ থানার মামলা নং-৬১, জিআর মামলা নং-৩৫২।
এদিকে, ঘটনার পরপরই বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর নুর মোহাম্মদসহ সঙ্গীয় ফোর্স ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। থানায় মামলা রেকর্ডের আগে ও পরেও একাধিক বার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও রহস্যজনক কারণে তিনি আসামীদের গ্রেফতার করেননি।
অভিযোগ রয়েছে, সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম স্বাক্ষী হওয়ার অপরাধে মা ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার প্রধাব আসামী ছৈয়দ করিম প্রকাশ ডেবিটকে বাদী বানিয়ে অন্যান্য আসামীদেরকে পুলিশ প্রভাবিত করে জমি সংক্রান্ত বিরোধের টাইপকৃত অভিযোগ নিয়ে থানায় কাউন্টার (পাল্টা) মামলা দায়ের করিয়েছেন। যা শুধু মাত্র হয়রানী ও আসামীদের রক্ষার কৌশল বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান স্বাক্ষী আবদুল হামিদ বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে ইনচার্জ ইন্সপেক্টর নুর মোহাম্মদ আমাকে বিভিন্ন ভাবে প্রলুদ্ধ করে। সুবিধা করতে না পেরে হুমকি দিয়ে আসছিল। সিনহা হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য না দিলে আমাকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিবে। আমার তার কথা কর্ণপাত না করায় আমাকে হত্যাসহ বিভিন্ন কৌশলে হয়রানী করবে বলে আগে থেকেই হুমকি দেয়। বিষয়টি আমি শামলাপুর সেনা ক্যাম্পে মৌখিক জানিয়ে ছিলাম এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাবের কাছেও লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছিল। সিনহা হত্যা মামলার স্বাক্ষী হওয়ার জেরে পরিকল্পিত ভাবে আসামী পক্ষকে দিয়ে এই মিথ্যা মামলা করিয়েছেন বলে তার অভিযোগ।
মামলার বাদী সাংবাদিক জাফর আলম বলেন, মামলায় যে সময়টা উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময় ( সন্ধ্যা ৭টায়) আমি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে ছিলাম। আমার মা ও স্ত্রীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনাটি অবহিত করতে গিয়েছিলাম সেখানে। কিন্ত মিথ্যা কল্পকাহিনী সাজিয়ে জমি সংক্রান্ত বিরোধের অভিযোগ তুলে আমি এবং আমার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কাউন্টার মামলা রেকর্ড করার ঘটনাটি আমি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবী করছি।
এব্যাপারে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে ইনচার্জ ইন্সপেক্টর নুর মোহাম্মদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিনহা হত্যা মামলার স্বাক্ষী আবদুল হামিদ ও সাংবাদিক জাফর আলমের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়টি আমি জানি না। টেকনাফ থানার ওসি মামলা রেকর্ড করেছেন, এবিষয়ে ওসি জানতে পারবেন বলে জানান তিনি।