চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেন ভ্রমণের সৌন্দর্য
যাত্রার শুরুতেই বিকট ঝন ঝন শব্দ জানান দেবে ট্রেন পার হচ্ছে শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু। দুই পাশে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর নিরবধি বয়ে যাওয়া দেখে মন জুড়াবে। শান্ত–শ্যামল গ্রামগুলো পার হতে না হতেই পাহাড়ি গর্জন বনের সবুজে হারাবে ট্রেনটি।
এরই মধ্যে দেখা মিলতে পারে বুনো হাতি, বানর কিংবা অন্য কোনো বন্য প্রাণীর। দুই পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের অনাবিল সৌন্দর্য, পাহাড়ি ছড়া, ঝরনা, রাবারড্যাম, নদ-নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে আড়াই ঘণ্টার ভ্রমণ শেষ, টেরও পাবেন না যাত্রীরা।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেন ভ্রমণে এম দুর্দান্ত সব দৃশ্য দেখে চোখ জুড়াবে। তবে এর জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই নতুন রেলপথ চালুর পরিকল্পনা আছে সরকারের। এই ট্রেনযাত্রায় শহরের পর, বোয়ালখালী, পটিয়া, দোহাজারী ও সাতকানিয়ার উপজেলা পার হলেই ধীরে ধীরে পাল্টে যাবে দৃশ্যপট, দেখা মিলবে সবুজ পাহাড়, টিলাসহ আরও কত কিছু।
সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার চুনতি যাওয়ার পথে আবারও দুই পাশে সংরক্ষিত অরণ্যের সারি সারি গাছ। হারবাং থেকে চকরিয়া পর্যন্তও ঘন বন, চকরিয়া সদরে ঢোকার পর কিছু দূর সমতল। এরপর ফাঁসিয়াখালী থেকে ডুলাহাজারা আবারও সংরক্ষিত সবুজ বনাঞ্চল। ডুলাহাজারা সাফারি পার্কও পাশে পড়বে যাওয়ার পথে।
এ ছাড়া মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল এলাকার মাঝখান দিয়েও যাবে ট্রেন। ঈদগাঁও রাবারড্যামের পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় দেখা যাবে রামুর রাবারবাগানও। এভাবে দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন কক্সবাজার।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চুনতি, ফাঁসিয়াখালী, মেধাকচ্ছপিয়ার মতো সংরক্ষিত বন পশুপাখি-বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃত। এর মধ্য দিয়ে যাবে ট্রেনলাইন। এ ছাড়া লোহাগাড়ায় টঙ্কাবতী খাল ও চকরিয়ার মাতামুহুরীর কিছু অংশ দেখতে পাবেন যাত্রীরা। দোহাজারী অংশে দেখা যাবে বান্দরবানের মদক পাহাড় থেকে নেমে আসা আঁকাবাঁকা সাঙ্গু নদীর প্রবাহ।
হিমশীতল, স্বচ্ছ-নীল জলরাশি আর দুই তীরে বারোমাসি ফসলের সমারোহ যার বুকে গড়ে ওঠে, সেই বাঁকখালী নদীর পাশ ঘেঁষেও যাবে ট্রেন। এঁকেবেঁকে যাওয়া কক্সবাজার-রামুর হৃৎপিণ্ড হিসেবে খ্যাত এই নদীর সৌন্দর্য বিমোহিত করে সবাইকে। সেই বাঁকখালী নদীর অনেকাংশ এবং ওই নদী অতিক্রম করে ট্রেন যাবে কক্সবাজারে।
আরো পড়ুন: ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দোহাজারী-কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু
ট্রেন থেকে নামার পর কক্সবাজার বাস টার্মিনালের অপর পাশে চৌধুরীপাড়ায় অবস্থিত নান্দনিক রেলওয়ে স্টেশন দেখে অনেকে হয়তো বিস্মিত হবেন! কারণ চোখে ধরা দেবে বিশাল ঝিনুক আকৃতির স্টেশন। এই ঝিনুকের ভেতরেই হচ্ছে প্ল্যাটফর্ম এবং যাত্রী আসা-যাওয়া ও বসার লাউঞ্জ।
এক রুটে এমন নদ-নদী, উঁচুনিচু টিলা, বনভূমি, রাবার বন, সাফারি পার্ক ও সমতল সবুজ প্রান্তর পেরিয়ে যাত্রীরা চলে যাবেন সমুদ্রতীরের একেবারে কাছেই। ভাবা যায়!
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন ‘একসঙ্গে এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেশে আর অন্য কোথাও নেই। ঝিনুকের আদলে রেলস্টেশন তো এই উপমহাদেশেই নেই’।
কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প চালু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি একটি ট্রেন যাবে কক্সবাজারে। ট্রেনটি চট্টগ্রামে থামবে। এটি শুধু পর্যটকের জন্য। ঢাকা থেকে রাত ৯টায় ছেড়ে কক্সবাজারে পৌঁছাবে সকাল ৬টায়। চট্টগ্রাম থেকেও সকাল-বিকেল পর্যটকদের নিয়ে দুটি ট্রেন যাবে কক্সবাজারে, মাঝপথে থামবে চকরিয়ায়। দুই ঘণ্টায় কক্সবাজারে পৌঁছাবে এ দুটি ট্রেন।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত ছয় জোড়া লোকাল ট্রেনও চলবে। এসব ট্রেন পথে দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাহ ও রামুতে থামবে। আপাতত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে রেলওয়ের মহাপরিচালকে দপ্তর থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
তবে ১১ বছর আগে হাতে নেওয়া এই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ পুরোপুরি সম্পূর্ণ হয়নি। এখনো কক্সবাজার জেলায় ২০ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম জেলায় ১০ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণ বাকি রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ভূমির মালিকেরা কোর্টে মামলা করেছেন। তাই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পারছেন না।
এ ছাড়া রেললাইনের কাছে থাকা ২২টি ওভারহেড ট্রান্সমিশন টাওয়ার ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সরানোর কথা থাকলেও এখনো সরানো হয়নি। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (গ্রিড সার্কেল) তাপস কুমার ভৌমিক টাওয়ারগুলো খুব শিগগিরই সরানো হবে বলে জানিয়েছেন।
এ রকম পাঁচ কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কাজ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও এক বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে কক্সবাজারে গিয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রেললাইন চালুর কথা বলেছেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারের এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগব্যবস্থার প্রবর্তন করা। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিপণ্য পরিবহন করা