“বনমালী তোমায় দেখেছি
আমার সুজন দিঘীর পাড়ে।
একটা অচেনা দৃষ্টি
হাজার শব্দ ভেলায় মেলাতে চায়,
ওই সুজন দিঘীর পাড়ে”।
কলেজ পাস করে শুভদীপ বর্তমানে বেকারত্বের কারাগারে আবদ্ধ। নিজের জীবনটা আজ….
“হিসাবের অঙ্ক খাতায় শুধু নিরাশার যন্ত্রণা”।
অনেক কষ্টে শুভদীপ শহরের একটা আপিসে খাতাপত্র সারার কাজ পেয়েছে মাত্র “আট হাজার সাতশো টাকা” মাসিক বেতনে। আর বাকি সময়ে কিছু ছেলে-মেয়েদের ব্যাচ করে পড়িয়ে কিছু টাকা আসে। ওখান থেকে যে টুকু টাকা ইনকাম হয় সেটা শুভদীপ নিজের রুম,রান্নার ও নিজের ব্যক্তিগত কিছু খরচে মোটামুটি চলে যায় আর বাকি টাকাটা বাড়িতে তুলে দিতে হয়। এই ভাবে শুভদীপের জীবনটা বেশ কাটছিল।
একদিন হঠাৎ শুভদীপকে আপিসের কাজে বদলি করে শিবপুর গ্রামে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন শহর থেকে ট্রেনে করে গ্রামের কাজে আসতে বেশ বেগ পেতে হতো শুভদীপকে। শুভদীপ গ্রামের একটা বাড়ি ঠিক করলো। সেখান থেকে কাজের অনেক সুবিধা। শুভদীপের বাড়ি থেকে দু কিলোমিটারের মধ্যে গ্রামের স্কুল।
একদিন হঠাৎ শুভদীপ স্নান ও খাওয়া-দাওয়া সেরে দশটায় আপিসের কাজে যাচ্ছিল এবং কিছুটা দূরে কয়েকজন স্কুলের মেয়েরা যাচ্ছিল দল বেঁধে। শুভদীপের কাছে আসতেই…
স্কুলের মেয়েরা বললো, দেখ দেখ নতুন সাহেব কোথা থেকে এলো রে?
সূচিতা বললো সাহেব আপনার বাড়ি কোথায়?
শুভদীপ ওদের দিকে তাকাতেই, স্কুলের মেয়েগুলো দৌড়ে পালিয়ে গেলো।
এই ভাবে প্রতিদিন ওই মেয়েগুলো শুভদীপের পেছনে লাগতো। শুভদীপ কিছু বলতে গেলেই সকলে ভয়ে দৌড়ে পালাতো।
এক রবিবার গ্রামের একটা বাড়িতে শুভদীপের নেমন্ত্রন পড়েছিল। সেখানে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পায় ওই মেয়েগুলোকে। তখন শুভদীপের মনের কোনে….
” এ যেন কেমন একটা অনুভূতি” !
তাদের মধ্যে একটা মেয়ে ছিল যার নাম সূচিতা। শ্যামচরণ হালদার উনার পিতা। শ্যামচরণ বাবু গ্রামের একজন ধনী ব্যাক্তি। আমাদের আপিসে শ্যামচরণ বাবুর বেশ নাম ডাক।সেই সূত্রে উনাদের অনুষ্ঠানে আমাকে নেমন্ত্রন করেছে।
সেদিন শুভদীপের কেমন একটা আলাদা আলাদা পরিবেশ লাগছিল। প্রথমে শ্যামচরণ বাবুকে প্রণাম জানালো শুভদীপ, শ্যামচরণ বাবুর সঙ্গে সেখানে অনেক কথা হলো শুভদীপের। শ্যাম চরণ বাবু উনার একমাত্র মেয়ে সূচিতার পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেখে তো… চক্ষু চড়ক গাছ ” বাবার সম্মুখে শান্ত অবলা বালিকা,
রাস্তার মোড়ে গ্যাঙস্টার”।
সেখানে খাওয়া দাওয়া সারলাম। তার পর প্রণাম ঠুকে বিদায় নিলাম। একদিন হঠাৎ শ্যামচরণ বাবু উনাদের বাড়ি থেকে কিছু উপহার মেয়ের হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। সেদিন একটা চমকপদ ঘটনা। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ। দরজা খুলতেই শ্যামচরণ বাবুর মেয়ে হাতে কিছু খাওয়ারের প্যাকেট। শুভদীপ সেদিন বোবা হয়ে পড়েছিল। সূচিতা বললো আপনি আমাকে দেখলে এমন ভয় পান কেন? শুভদীপ বললো? কে বললো আপনাকে দেখে ভয় পাই। দুজনে কিছুক্ষণ চুপ। শুভদীপের ইতিবৃত্তান্ত জানতে চাইলেন সূচিতা। শুভদীপ বললো আপনারা অনেক বড়ো লোক। আমাদের মতো নিম্নগোত্রীয়ের জীবনটা টেনে টুনে চলে কোন রকম। সেদিন সূচিতা আর বেশী কিছু বলেনি। মুখটা গোমড়া করে বাড়ি ফিরে এসেছিল। আজ শুভদীপ কিসের যেন একটা দোরগোড়ায় দাড়িয়েছে ….
“একটা বক্রপথে কেউ জীবনটা সাজাতে চায়। আজ সেই দূরত্বে চাঁদ ও সূর্যের ফারাক”।
সূচিতা কোথা থেকে জানতে পারে শুভদীপ আগে ছেলে মেয়েদের বাংলা ও সংস্কৃত পড়াতো। শ্যামচরণ বাবু একদিন মেয়ের বায়নায় বলে বসলেন। শুভদীপ বাবু আমার মেয়ে আপনার কাছে পড়তে চায়। শ্যামচরণ বাবুর মুখের কথায় না বলতে পারলেন না শুভদীপ। প্রতি সপ্তাহে রবিবার করে পড়তে আসতো সূচিতা। সূচিতা খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। নাচ,গান,আবৃত্তি, সবই পারে। গ্রামে বেশ কয়েকদিনের মধ্যে শুভদীপের নাম ছড়িয়ে পড়লো। কখন যে সূচিতা শুভদীপকে ভালোবেসে ফেলেছে ,শুভদীপ জেনেও মুখ বুজে থাকতো।…..
“আজ সূচিতার চোখে শুভদীপের জন্য অনেক শ্রদ্ধা। আধুনিকতায় মুখ থুবড়ে পড়া তার সাম্রাজ্যটা অনেক ছোট”… তবুও একটা অচেনা ভালো লাগা সূচিতা ও শুভদীপের চোখের নতুন স্বপ্ন। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে শুভদীপের বাড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া….
“তোমার হৃদয় মাঝারে,
আমার জীবন গড়া।
যদি হারিয়ে যাও এ জীবন কি রইবে?”
— একটা অজানা আতঙ্ক বাব বার শুভদীপকে ভাবাচ্ছে। যদি শ্যামচরণ বাবু জানতে পারেন উনার মেয়েকে শুভদীপ ভালোবাসে তাহলে তো শুভদীপের প্রতি শ্যামচরণ বাবুর বিশ্বাস মাটির তলায় মিশে যাবে। শুভদীপ অনেক চিন্তা ভাবনা করে সূচিতার থেকে দূরে থাকতে চায়। কারণ শুভদীপ খুব গরীব পরিবারের সন্তান। একটা বেকারত্বের গ্যাজুয়েট নিয়ে ওই রাজমহলের রাজকন্যাকে ভাঙা কুঁড়ে ঘরে বাঁধতে চায়না। সূচিতার প্রেমের কথা গ্রামের মানুষ জন জানতে পারলে বিশ্বাস ভেঙে যাবে। তাই শিবপুর গ্রামের আপিস থেকে একসপ্তের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিল শুভদীপ। শুভদীপ আজ অনুভবে বুঝতে পেরেছে সূচিতা তার জীবনের ক্ষততে মিশে গেছে। আবার তাকে শিবপুর গ্রামে টেনে নিয়ে এলো সূচিতার প্রেম। একদিন হঠাৎ সূচিতা শুভদীপের বাড়িতে এসে তার মনের সব কথা শুভদীপকে জানায়। শুভদীপ সূচিতাকে বলে…
“চাঁদ সূর্যের দূরত্ব দেখেছেন? ”
সূচিতা শুভদীপকে বলে…”জানিনা ! তোমাকে না দেখলে জীবনের শেলগুলো বন্ধ হয়ে আসে”। শুভদীপ কখনো মুখফুটে শ্যামচরণ বাবুকে তার মনের কথা বলতে পারবে না। কারণ আপিসে একটা সামান্য কর্মচারী মাস গেলে মাত্র আট হাজার সাতশো টাকা বেতন।আর শ্যামচরণ বাবুদের চাকর এর থেকে অনেক বেশি বেতন পায়। উনারা অনেক বড়ো লোক নাম পতি-পত্তি সবই আছে। এই সব ভাবনা গুলো শুভদীপকে অনেকটা পিছিয়ে দেয়।
হঠাৎ একদিন সূচিতা তার মনের কথা বাবা ও মা কে জানায়। সেদিন কি ধুমধুমার কান্ড। হঠাৎ তলফ করা হলো শুভদীপকে….
শ্যামচরণ বাবু মেয়ের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনেক প্রশ্ন করলেন। শুভদীপ সেদিন কিছুই বলেনি….
“দুচোখের ওই অশ্রু গুলো তার উত্তর”।
তড়িঘড়ি শ্যামচরণ বাবু শুভদীপকে অন্য আপিসে বদলি করে দেওয়া কথা বলে আপিসের ম্যানেজার সাহেবকে। যথারীতি পরদিন সকালে বিদায় বেলায়….
“ওই অশ্রু ভেজা কান্না। সূচিতার দিক