ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

প্রতিবেদক
সিএনএ

সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১ ১০:৫৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

প্রতিষ্ঠাতা পদ নিয়ে টানাটানি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও করোনায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধসহ নানা কারণে ধ্বংসের পথে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। দীর্ঘদিন দুই পক্ষের চলমান মামলায় আইনি জটিলতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ কার্যক্রমে অচল অবস্থা দেখা দিয়েছে। এ জন্য স্টুডেন্ট ফোরামের ব্যানারে ২০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।

জানা যায়, ২০১৩ সালে জেলা শহরের কলাতলী মোড়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে গড়ে উঠে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। লায়ন মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠাতা ও সালাহ উদ্দিন আহমদকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করে ১০ সদস্যের ট্রাস্ট বোর্ড নিয়ে শুরু থেকে ভালোই চলছিল শিক্ষা কার্যক্রম। এক বছর আগে থেকে প্রতিষ্ঠাতা পদ নিয়ে শুরু হয় টানাটানি।

ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা লায়ন মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন আহমদ নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা দাবি করেন। লায়ন মুজিবুর রহমান সালাহ উদ্দিন আহমদকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মেনে নিলেও প্রতিষ্ঠাতা মানতে রাজি নন। ইউনিভার্সিটি এক বছর আগে থেকে দখলে নেন সালাহ উদ্দিন আহমদ।

এ নিয়ে একে-অপরের সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এসব মামলা জটিলতায় স্থবির হয়ে পড়ে শিক্ষা কার্যক্রম। ১২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে চালু হওয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০০ জনে নেমে আসে। এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় স্টুডেন্ট ফোরামের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ২০ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন।

স্টুডেন্ট ফোরামের দাবিগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ, স্থায়ী ক্যাম্পাস, উন্নত ক্লাসরুম, যোগ্যতাসম্পন্ন রেজিস্ট্রার, প্রক্টর ও ডিন, পর্যাপ্ত মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, নিজস্ব লাইব্রেরি ও কার্যকর ওয়েবসাইট, হিসাবরক্ষণ বিভাগকে পুনর্বিন্যাস, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেমিস্টার সম্পন্ন, জরিমানা ও সেমিস্টার ফি’র জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম, ট্রাস্টি বোর্ড ও প্রশাসনের দ্বন্দ্ব থেকে শিক্ষা কার্যক্রম মুক্ত রাখা, নিরপেক্ষ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিশ্চিতকরণ, একাডেমিক ক্যালেন্ডার, কমন রুম ল্যাব সুবিধা নিশ্চিতকরণ, জাতীয় দিবস, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা সফর ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট এবং কর্মশালার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ, প্রতিষ্ঠিত এবং সক্রিয় ক্লাবসমূহকে প্রণোদনা ও অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ, ক্যানটিন সুবিধা নিশ্চিতকরণ, মানসম্মত শৌচাগার নিশ্চিতকরণ, বহিরাগতদের বিচরণ বন্ধ, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ট্রাস্টি বোর্ডের দ্বন্দ্বের নিরসন।

এ বিষয়ে স্টুডেন্ট ফোরামের মুখপাত্র আরিফ সাঈদ বলেন, প্রত্যেক সেমিস্টার (ছয় মাস) থেকে প্রায়ই আড়াই কোটি টাকা আয় করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অথচ আমাদের নেই মানসম্মত শৌচাগার। নামেই ইউনিভার্সিটি। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা অনেকবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বারবার আশ্বাস দিয়েছে তারা। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।

জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা দাবিদার লায়ন মুজিবুর রহমান বলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়া কক্সবাজার জেলাকে এগিয়ে নিতে ইউনিভার্সিটিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১০ সদস্য বিশিষ্ট ট্র্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। পরে ট্রাস্ট গঠন সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সালাহ উদ্দিন আহমদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টের চেয়ারম্যান করা হয় বিনা অর্থে। আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২১ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে মতামত দেওয়ার জন্য চিঠি দেয়। সেই অনুযায়ী একই বছরের ২৬ জুন ইউজিসির তদন্ত টিম সরেজমিন পরিদর্শনে আসে। এ সময় আবেদনপত্রে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমাকে প্রতিষ্ঠাতা, নিজেকে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং বাকি আট সদস্যকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন সালাহ উদ্দিন। তদন্ত টিমের পরামর্শ মোতাবেক ২৭ জুন সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে আমাদের ট্রাস্ট দলিল রেজিস্ট্রেশন করি এবং তদন্ত টিমের কাছে জমা দিই। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমার স্বাক্ষরে দলিল সম্পাদিত হয় এবং গ্রহীতা হিসেবে সালাহ উদ্দিনসহ ১০ জন সদস্য স্বাক্ষর করেন। পরে তদন্ত টিম তথ্য-উপাত্ত বিবেচনা করে একই বছরের ৩ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। সুপারিশের ভিত্তিতে আমাকে প্রতিষ্ঠাতা নির্ধারণ করে ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ৬ অক্টোবর ইউজিসি কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অনুমোদন দেয়।’

মজিবুর রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে সালাহ উদ্দিন আরেকটি ভুয়া ট্রাস্ট দলিলের মাধ্যমে নিবন্ধনের জন্য ছাড়পত্র নিয়ে সাবমিট করেন। ইতোমধ্যে আমরা বিষয়টি নিয়ে রেজিস্ট্রারের কাছে অভিযোগ দিয়েছি এবং আদালতে মামলা করেছি। চট্টগ্রামের ১ম যুগ্ম জেলা জজ আদালত ইতোমধ্যে সালাহ উদ্দিনের করা ভুয়া ট্রাস্ট দলিল কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না মর্মে জবাব চেয়েছেন। জবাব না দেওয়া পর্যন্ত ট্রাস্টের সব কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।’

শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের দাবিতে মানববন্ধন করেছে স্টুডেন্ট ফোরাম।

তবে সালাহ উদ্দিন আহমদ নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দাবি করে বলেন, ‘আমিই কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা। ইউনিভার্সিটির আবেদনকারী। ২০১৩ সালের ১২ মে আমাকে প্রতিষ্ঠাতা করে দলিল করা হয়। আবেদনে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সরকারের বরাবর অঙ্গীকারনামা প্রদানকারীও আমি। ২০১৩ সালের ২ মে অঙ্গীকারনামা দেওয়া হয়। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের আবেদনকারী হিসেবে আমি আবেদনে স্বাক্ষর করি এবং বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রথম প্রস্তাবিত উপাচার্য শ্যামল কান্তি বিশ্বাস, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারকে নিয়োগ দিই আমি। তারা আমার বরাবরে যোগদানের সম্মতিপত্র দেন। একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভবনের ভাড়া চুক্তি সম্পাদন করি। গত বছর লক্ষ্য করি, বেসরকারি ইউনিভার্সিটির সাময়িক অনুমতি প্রাপ্তির আবেদন ফরমের ৩ নম্বর ক্রমিকে প্রতিষ্ঠাতার নাম ও ঠিকানার অংশ পাল্টে আমার স্থলে মুজিবুর রহমানের নাম ও ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ১০ সদস্যদের নাম ও ঠিকানার জায়গায় মো. মুজিবুর রহমানের পরিবারের নয় সদস্যের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।’

মুজিবুর রহমান দুর্নীতিবাজ এবং ইউজিসির চিঠির কথা উল্লেখ করে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফাউন্ডার হিসেবে শুরু থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতেন মুজিবুর রহমান। ১২০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে প্রতি বছর সাত কোটি টাকা আয় হয়। প্রতিদিন ব্যাংকে জমাকৃত টাকাগুলো সন্ধ্যায় নামে-বেনামে চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করেন মুজিবুর ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসাব পরিচালনাকারী আব্দুর সরুর। দুই জন মিলে ব্যাংক শূন্য করে বিশ্ববিদ্যালয় দেউলিয়া বানিয়ে দিয়েছেন। পরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে গত বছর তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। যা এখনও চলমান।’

এদিকে, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের দাবিতে মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) মানববন্ধন করেছে স্টুডেন্ট ফোরাম। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। করোনা সংক্রমণের দেড় বছরে অনলাইন ক্লাস নেয়নি। কিন্তু কোর্স ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎ করছে কর্তৃপক্ষ। ইউনিভার্সিটিতে এখনও ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিয়মিত ট্রেজারার নেই। গত আট বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়তে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

সম্পর্কিত পোস্ট