দেশের ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্নখাতে প্রতারণা করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিলেও তা দেরিতে নেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, সরকার তখনই পদক্ষেপ নিলো, যখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এ সময় ই-কমার্স প্রসঙ্গেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
মাইক্রোক্রেডিটের (ক্ষুদ্রঋণ) নামে সুদের ব্যবস্থা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের করা রিটের শুনানিতে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। পরে এ বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করেছেন আদালত।
এহসান গ্রুপ, ই-ভ্যালিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে হাইকোর্ট আরও বলেছেন, সরকার পদক্ষেপ নেয় কিন্তু সেটা জনগণ নিঃস্ব হওয়ার পরে।
সুদ কারবারিদের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিটের শুনানিতে প্রতারিত মানুষের অবস্থা তুলে ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন।
আদালতে আজ রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুর উস সাদিক।
হাইকোর্ট বলেন, সরকার তো পদক্ষেপ নিচ্ছে কিন্তু সেটা কখন? যখন আমি (গ্রাহক) নিঃস্ব হয়ে গেলাম, আমার রেমিডিটা (প্রতিকার) কোথায়? আমার টাকাটা নিয়ে গেলো, আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরতেছি। সে থানায় যাবে, জেলে যাবে যাক। কিন্তু আমার টাকাটা যে নিয়ে গেলো সেটা কোথায়? আমরা মামলার করার পর চোর ধরা পড়ছে। চুরি তো ঠেকানো যাচ্ছে না।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, আমার বাড়ি কেন অরক্ষিত? আমার বাড়ি মানে বাংলাদেশ। দেশের মানুষ দরজা-জানালা বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমাবে কিন্তু আমার ঘর কেন অরক্ষিত? মানুষের টাকা কেন লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এইগুলো বন্ধ করা কাদের দায়িত্ব? এটা আমরা দেখতে চাই। আমরা এটা পরীক্ষা করতে চাই।
তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নুর উস সাদিক বলেন, মাই লর্ড, সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা কিন্তু নয়। এহসান গ্রুপের তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ই-ভ্যালির তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তখন আবার আদালত বলেন, সরকার তো নিচ্ছেন কিন্তু সেটা কখন? যখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সরকারের কাজ কী? এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, তাদের আইনের শাসন সমস্ত কিছু তারা সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। সেখানে সরকার ঠিকমতো কাজ করছে কি-না আমরা দেখবো। পরে মামলাটি শুনানির জন্য আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখ ঠিক করে দেন আদালত।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর ক্ষুদ্রঋণের নামে সুদের ব্যবস্থা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়। রিট আবেদনে সারাদেশের সুদ ব্যবসায়ীদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। রিটে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ৬৪ জেলার ডিসি ও এসপিকে বিবাদী করা হয়।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে জনস্বার্থে গত ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এ রিট করেন।
তখন সুমন বলেন, দেশের প্রত্যেক গ্রাম ও মহল্লায় সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন নামে সুদের লেনদেন চলছে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ঋণের নামে উচ্চ হারে সুদ নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন। তাদের কোনো নিবন্ধন নেই। গরিব অসহায় মানুষগুলো সুদ কারবারিদের কাছে জিম্মি। তাদের সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে আদায় করা সুদের পরিমাণও গরিব মানুষের কাছে খুব বেশি।
তিনি বলেন, এদের নেটওয়ার্ক যদি ভেঙে দেওয়া যায়, তাহলে দাদন কারবারিদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া কোনো বিষয় না। এজন্য ডিসি-এসপি তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এটা যদি কোনোভাবে ভেঙে দেওয়া যায় তাহলে দেখবেন অনেক অনেক মানুষ বেঁচে যাবে।
এই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশে ৮৪টি মাইক্রোক্রেডিটের (ক্ষুদ্রঋণ) অথরিটি লাইসেন্স আছে। অথচ হাজার হাজার মানুষ সুদের কারবার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এটা নিয়ে কোনোভাবে নাড়াচাড়া করে তাহলেই হবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার চাইলে এই নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া সম্ভব।
সুমন আরও বলেন, দাদন ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক ভাঙতে কাউকে গুলি করতে হবে না। বড় কোনো অভিযান চালাতে হবে না। শুধু কারা কারা এই দাদন কারবারের সঙ্গে জড়িত তাদের তালিকা করলেই হবে। সফলতার মাত্রায় আমরা আরেকটা জিনিস যোগ করতে চাই, শপথ নিতে চাই দাদন কারবার নিয়ন্ত্রণে। তবেই সোনার বাংলা হবে এই দেশ।