সিএনএন ডেক্স:
কক্সবাজার পৌর সচিব রাসেল চৌধুরীর লাগামহীন দূর্নীতি স্ত্রী ও নামে বে নামে সম্পদের পাহাড়।
রাসেল চৌধুরী কক্সবাজার পৌরসভার সচিব হিসেবে কর্মরত। । তখন তার বেতন ছিল ৩ হাজাতীয় বেতন স্কেল ৭ম গ্রেডের কর্মচারী তিনি। বেতন সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার টাকা। চাকরিতে প্রবেশ করেন ২০০৬ সালে । ২০১৬ সালে সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। সচিব হিসেবে তার ৮ বছর চাকরিজীবনে বেতন-বোনাস মিলিয়ে আয় হওয়ার কথা ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকা। ১৭ বছরের চাকরিজীবনে তার আয়ের পরিমাণ সোয়া কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ সরকারি এই কর্মচারীর বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।
রাসেল চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা গ্রামে। তার বাবার নাম মমতাজ মিয়া। আট ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল পঞ্চম। একসময় অভাব-অনটন লেগে থাকা হতদরিদ্র পরিবারের এই ছেলের চট্টগ্রাম শহরের খুলশী ও চকবাজারে আছে একাধিক প্লট ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। বান্দরবানে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তুলেছেন গরুর খামার, লোহাগাড়া উপজেলায় আছে মার্কেট, গ্রামের বাড়িতে আছে কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। চড়েন ৩৮ লাখ টাকা দামের প্রিমিও গাড়িতে। বিভিন্ন ব্যাংকে নিজের ও স্ত্রীর নামে কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স। অভিযোগ আছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কমিশন-বাণিজ্য করে বিপুল এই অর্থ কামিয়েছেন রাসেল।
তবে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাসেল চৌধুরীর অর্জিত প্রায় সব সম্পদ গড়েছেন তার স্ত্রী নুসরাত জাহানের নামে। যদিও এই নুসরাত জাহান একজন সাধারণ গৃহিণী। তার আয়ের তেমন কোনো উৎস নেই। ২০২২ সালে চট্টগ্রামের আয়কর অফিসে রিটার্ন দাখিলের সময় এই নুসরাতই তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, ২০০৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৩ হাজার ৩০০ টাকা বেতনে সহকারী সচিব হিসেবে বান্দরবান পৌরসভায় যোগ দেন রাসেল। সেখান থেকে ২০০৭ সালের ৩ মে বদলি হন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভায়। পরে সন্দ্বীপ ও চন্দনাইশ হয়ে ২০১৬-১৭ সালের দিকে সচিব হিসেবে কক্সবাজার পৌরসভায় যোগ দেন।
২০২০ সালের ১১ নভেম্বর কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে এই রাসেল চৌধুরীসহ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ২৪ জনকে তলব করেছিল দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীন (চাকরিচ্যুত)। রাসেলসহ এই ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত এখনো চলছে বলে জানিয়েছে দুদকের একটি সূত্র। তবে রাসেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন দুদকের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম।
দুদক সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলায় দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প, বিমানবন্দর আন্তর্জাতিকীকরণ প্রকল্প, মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বেশ কিছু প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দালালদের সিন্ডিকেট জমির মালিকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বিষয়টি নজরে আসার পর এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
সূত্রটি জানায়, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ ওয়াসিম নামে কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এক সার্ভেয়ারকে নগদ টাকাসহ আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে একই বছরের ২২ জুলাই মো. সেলিম উল্লাহ, ৩ আগস্ট মোহাম্মদ কামরুদ্দিন ও সালাহ উদ্দিন নামে তিন দালালকে আটক করে দুদক। আটকের সময় এসব দালালের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার নগদ চেক ও ভূমি অধিগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ মূল নথি উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুদককে জানায়, কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সিন্ডিকেট করে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের কাছ থেকে কমিশনের নামে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। ওই সিন্ডিকেটে পৌরসভার সচিব রাসেল চৌধুরীসহ কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুসন্ধান করে আলোচ্য প্রকল্পগুলোয় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পায় দুদক। এরপর পৌরসভা সচিব রাসেল চৌধুরী, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনকে ২০২০ সালের ১৫ থেকে ২২ নভেম্বরের মধ্যে দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ে সশরীরে হাজির হওয়ার জন্য নোটিস দিয়েছিলেন তৎকালীন সহকারী উপপরিচালক শরীফ উদ্দিন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট কসমোপলিটন আবাসিকের বিপরীতে সিডিএর নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের ছয়তলায় তার নামে রয়েছে ৮০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট। চকবাজার থানার চট্টেশ্বরী রোডে বেভারলি হিল আবাসিক এলাকায় ‘আইডিয়াল প্যানারোমা’ নামের ভবনের দোতলায় আছে ১ কোটি ৪ লাখ টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট। এটি কেনার পর আরও ৭০ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে করা হয়েছে ইন্টেরিয়র ডিজাইন। এই ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রাসেল।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কক্সবাজার থেকে নিজের মালিকানাধীন প্রিমিও এফ প্রাইভেট কারে করে ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করেন রাসেল। যার নম্বর চট্ট মেট্রো-গ ১১-৮১৯৩। গাড়ির মালিক যে রাসেল সে তথ্য বিআরটিএ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে এই ফ্ল্যাট বাড়ির সামনেই আছে ‘মিসমাক ফেরদৌস’ নামের ছয়তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বহুতল ভবন। এই ভবনের দোতলায় স্ত্রী নুসরাত জাহানের নামে কিনেছেন ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট। যার প্লট নম্বর-১২১২, ফ্ল্যাট নম্বর-সি-১। তবে কর ফাঁকি দিতে নিবন্ধনের সময় দলিলে ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা সদর রেজিস্ট্রি অফিসে স্ত্রী নুসরাতের নামে ওই ফ্ল্যাটের দলিল নিবন্ধন হয় (দললি নম্বর-২৭৪০)। ফ্ল্যাটটির রেজিস্ট্রি দাতার নাম মো. আবু বকর। এ ছাড়া দক্ষিণ খুলশীর ১ নম্বর রোডে আছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ কাঠার একটি প্লট। ২০২২ সালের ১০ মে জনৈক হাসান আহমেদ নামের এক ব্যক্তির থেকে প্লটটি স্ত্রী নুসরাতের নামে কেনেন রাসেল। দলিল নম্বর ৭৫০৪। কর ফাঁকি দিতে এই দলিলে এই প্লটের দাম দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা।
খুলশী থানা এলাকার ওই প্লটটির অবস্থান হলো, নগরের ডবলমুরিং থানাধীন দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার নামজারি খতিয়ান নম্বর-৩১৭/১১ এবং নামজারি খতিয়ান ৩৮১৭। বিএস দাগ নম্বর-২৬৯৭ আন্দর ০৩ শতক এবং বিএস ২৬৯৮ দাগ আন্দর ০৩.৬৬ শতাংশ মোট ০৬.৬৬ শতাংশ জমি। সম্প্রতি এই প্লটে বাড়ি নির্মাণের জন্য সাড়ে ১০ তলার একটি নকশাও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই প্লটে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সেখানে একটি গভীর নলকূপও বসানো হয়েছে বলে জানা গেছে। নুসরাত জাহানের এসব প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিকানা সংক্রান্ত দলিল ও কাগজপত্র দেশ রূপান্তরের কাছে আছে।
বান্দরবানে বিশাল এলাকাজুড়ে রাসেলের বাবা মমতাজ মিয়ার নামে রয়েছে একটি গরুর খামার। খামারটিতে প্রায় দেড় কোটি টাকার গরু রয়েছে। লোহাগাড়া উপজেলা সদরে রয়েছে একটি মার্কেট। মার্কেটটি দেখাশোনা করেন তার বড় শ্যালক মো. আমজাদ হোসেন। ২০২১ সালে তার বাবা মমতাজ মিয়া মারা যাওয়ার পর ৪০ লাখ টাকা খরচ করে গ্রামের বাড়ির চারপাশে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে।
সাতকানিয়া ও কক্সবাজার এলাকায় নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি। বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইউসিবিএল ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে তার সঞ্চিত রয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। স্ত্রী নুসরাতের দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। নুসরাত জাহানের নামে এত সম্পদ ও কোটি কোটি টাকার ব্যাংক লেনদেন থাকলেও আয়কর ফাইল (টিআইএন নম্বর-৭৮৮০৮৮৪৭৫৯৩৬-কর অফিস, সার্কেল-২২, কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রাম) ওপেন করেছেন ২০২১ সালে। যেখানে বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে নুসরাত জাহানের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, লোহাগাড়া উপজেলা শাখায় তার একটি হিসাব নম্বর হচ্ছে-২০৫০১৫৬০২০৩২২৮৪০০। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত স্টেটমেন্টে দেখা যায়, ১০ বছরে তার এই অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৯ দশমিক ১১ টাকা। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (এজেন্ট ব্যাকিং সার্ভিস ব্রাঞ্চ) চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি খোলা ২০৫০৭৭৭০২১২১০৩৭২৮ অ্যাকাউন্ট (টাইপ এমএসএ-রেগুলার) নম্বরে এক দিনেই জমা হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার টাকা।
৭ম গ্রেডের বেতনে সরকারি চাকরি করে স্ত্রীর নামে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার উৎস সম্পর্কে জানতে ১৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে কল করলে রাসেল চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আপনি (প্রতিবেদক) আমার বিরুদ্ধে যা তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন তা পত্রিকায় ছাপিয়ে দেন। আমার কিছু বলার নাই।’ একই দিন বেলা ৩টা ১০ মিনিটে তার স্ত্রী নুসরাতের মোবাইল ফোনে কল করেন এই প্রতিবেদক। সাধারণ গৃহিণী হয়ে কীভাবে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হলেন? এমন প্রশ্ন করলে নুসরাত বলেন, ‘আমার স্বামীর অবৈধ সম্পদ নেই। সরকারি চাকরির পাশাপাশি বান্দরবানে তার আছে বিশাল গরুর খামার। আমিই স্বামীকে ব্যবসার জন্য টাকা দিয়েছি। এক এক করে তিনি সম্পদ জোগাড় করেছেন। আপনারা খোঁজ নিন।’ আপনি তো সাধারণ গৃহিণী স্বামীকে দেওয়ার জন্য এত টাকা কোথায় পেলেন, এমন প্রশ্ন করলে নুসরাত রেগে গিয়ে বলেন, ‘জবাব দিলে দুদককে দেব। আপনি আর আমাকে ফোন করবেন না।’এ দিকে সচেতন মহলের দাবী তার বিরুদ্ধে তদন্ত সহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হউক।