ঢাকামঙ্গলবার , ১৫ জানুয়ারি ২০১৯
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ইয়াবা ব্যবসীয়দের আত্মসমপর্ণের খবরে তোলপাড়

প্রতিবেদক
সিএনএ

জানুয়ারি ১৫, ২০১৯ ৬:০৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

নিউজ ডেস্ক: ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমপর্ণের খবরে কক্সবাজারে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই খবরে ইয়াবা গডফাদাররা খুশি হলেও সাধারণ মানুষ অখুশি। তারা চায় জাতি ধ্বংসকারি ইয়াবা কারবারিদের উপযুক্ত শাস্তি। আর ইতিমধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের পরিবারের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যাদের মারা হয়েছে তাদের এই সুযোগ না দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে কেন ? চুনোপুটিদের মারার পর এখন যখন ইয়াবা গডফাদারদের পালা তখন আওয়াজ উঠছে আত্মসমপর্ণের কথা। চুনোপুটিদের যারা ব্যবহার করেছেন তারা তাদের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেননি। এখন নিজেরা বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় ও সামাজিক গণমাধ্যমে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্ণের মাধ্যমে ক্ষমা করে দেয়ার খবর প্রচার শুরু হয়েছে। আত্মসমপর্ণ করে বাঁচার জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে ইয়াবা কারবারিরা। এসব নানা আলোচনা সমালোচনায় তোলপাড় হয়ে উঠেছে কক্সবাজার।
এর মধ্যে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ইয়াবা কারবারিসহ এলাকার মানুষকে জড়ো করে সকল ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমপর্ণ করার আহবান জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় শীর্ষে থাকা ইয়াবা ব্যবসায়ী ১০ম জাতীয় সংসদের সদস্য আবদুর রহমান বদি।
আবদুর রহমান বদি বলেন, তোমরা যারা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত আছো, যারা তালিকাভুক্ত বা তালিকাভুক্তের বাইরে আছো তোমরা আত্মসমপর্ণ করো। আগামী ৫ দিনের মধ্যে ইয়াবা কারবারিরা আমার সাথে যোগাযোগ করো। আমি আত্মসমপর্ণ করিয়ে দেব। যা করেছো করেছো, আর করবেনা। এসো সবাই মিলেমিশে তাওবা করে টেকনাফের মধ্যে এটা প্রমান করবো আমরা ইয়াবামুক্ত হয়েছি। শুক্রবার সন্ধ্যায় টেকনাফের লামাবাজারে নিজের বাড়িতে স্ত্রীকে নিয় এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমান বদি।
ইয়াবা চোরাচালানে জড়িতদের আত্মসমর্পণের জন্য পাঁচ দিনের সময়ও বেঁধে দিয়ে তিনি বলেন, উখিয়া-টেকনাফে কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী থাকতে পারবে না। কেউ যদি আত্মসমর্পণ না করে, পরে তাদের পরিণতি ভয়াবহ হবে। টেকনাফের ছেলে হারা মা-বাবা, স্বামীহারা স্ত্রী ও বাবাহারা সস্তানদের কথা চিন্তা করে এ উদ্যোগ নিয়েছি। এদিকে আবদুর রহমান বদির এমন বক্তব্যের পর নানা আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় ইয়াবা কারবারিদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আবদুর রহমান বদির নাম। গত ২ মেয়াদের এই সাংসদের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারিদের মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইয়াবা পাচারের ‘হোতা’ হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় নাম রয়েছে তার। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের মধ্যে বদির এক বেয়াইও ছিলেন। ইয়াবা কারবারিদের তালিকায় তিনিসহ তার পরিবার ও নিকট আত্মীয়ের ২৫ জনের নাম রয়েছে। এসব কারণে সমালোচিত বদি এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি, তার স্ত্রী শাহিন আকতার চৌধুরী নৌকার প্রার্থী হিসেবে কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে তালিকায় শীর্ষে থাকা ইয়াবা কারবারি আবদুর রহমান বদি সবাইকে আত্মসমপর্ণের কথা বলেছেন। কিন্তু তাকে কে আত্মসমপর্ণ করাবে এই প্রশ্ন তুলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর জানান, ইয়াবা কারবারিদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে সবাই এই সুযোগকে পূঁজি করে সবাই ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়বে। পরে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবে।
টেকনাফের বহুল আলোচিত কমিশনার একরাম হত্যাকান্ডের একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, ইয়াবায় জড়িত না থেকেও বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে প্রাণ দিত হলো র‌্যাবের হাতে। আর এখন যারা প্রকৃত ইয়াবা কারবারি তাদের আত্মসমপর্ণের নামে বাঁচিয়ে দেয়া যদি হয়, তাহলে এটা কেমন বিচার ? যদি তাই হয় তাহলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারনে যারা আমার স্বামীকে হত্যার করতে ষড়যন্ত্র করেছে তারা এখন আত্মসমপর্ণের নামে বাঁচার চেষ্টা করছেন।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ গুরা মিয়া জানান, আমাদের এমপি বদি সাহেব সীমান্তে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমপর্ণের কথা বলেছেন। এটা ভাল কথা , কিন্তু যারা হাজার কোটি টাকা এ কারবারে হাতিয়ে নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন এবং দেশে নানা স্থাপনা করেছেন তাদের কি হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় এমপি আবদুর রহমান বদির নাম শীর্ষে রয়েছে। এখন তাদের ব্যাপারে কি হবে।
শুধু তাই নয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি জানান, জলদস্যু আর ইয়াবা বিয়ারী এক জিনিস নয়। জলদস্যুরা দস্যুমি করে হয়তো গুটি কয়েকজনকে হত্যা করেছে কিংবা কিছু টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে সংসার চালিয়েছে । কিন্তু ইয়াবা বিয়ারিরা সমাজসহ পুরো জাতিকে ধ্বংস করেছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো: আলী জানান, মুলত যারা ইয়াবা বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। তালিকায় থাকলে এটা প্রমান করে না যে, তারা সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী। অপরাধ না করে তালিকায় থাকলে তাদেরকে আত্মসমপর্ণ করতে হবে এটা মানে হতে পারেনা। আর যারা আসলে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, কোন অপরাধী অপরাধ স্বীকার করে আত্মসমপর্ণ করতে চাইলে তা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় বিবেচনা করবে। এমপি আবদুর রহমান বদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে হয়তো নিজ তাগিদে সবাইকে আত্মসমপর্ণ হওয়ার জন্য বলেছেন। তবে এখনো পর্যন্ত ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমপর্ণের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিরা
ইয়াবা অনুপ্রবেশের ঘাটি কক্সবাজার জেলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিরা আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। স্বেচ্ছায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আগ্রহী এই ইয়াবা কারবারীদের ডাকে সাড়া দিয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী মহল। দীর্ঘদিন এ ব্যবসা থেকে অর্জন করা অর্থের মায়া ভুলে প্রায় ১২০-১৫০ জন ইয়াবা কারবারি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় থাকা এসব ইয়াাবা কারবারিদের মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট জেলার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় ৭৩ জন মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন রয়েছে। তাছাড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকার ১ হাজার ১৫১ জনের মধ্যে এরা সবাই আছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, প্রায় ১৫০ জনের মতো দেশি-বিদেশী ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ বিষয়টি নিয়ে ১ মাস ধরে কাজ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল।
পুলিশ জানায়, মূলত সরকারের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পুলিশ প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে জন্য হাত দেন। পুলিশ সূত্রে আরো জানা যায়, ইতিমধ্যে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশের হেফাজতে চলে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের চট্টগ্রাম অফিসের প্রতিবেদক এম এম আকরাম হোসেনের মধ্যস্থতায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে এই ইয়াবা ব্যবসায়ীরা।
এবিষয়ে এম এম আকরাম হোসেন বলেন, গত ২০ অক্টোবর আমার মধ্যস্থতায় র‌্যাবের সহযোগিতায় কক্সবাজারের মহেশখালীর ৫টি জলদস্যু বাহিনীর ৩৭ জন সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন করে এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটির কাজ করছি। এদিকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক বিক্রির অর্থ বাজেয়াপ্ত করবে সরকার। প্রথমে দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ আত্মসমর্পণ করা এই কারবারিদের সম্পদের তদন্ত করবে। তদন্তের পর ইয়াবা ব্যবসা থেকে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খুব শীঘ্রই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি হতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহের প্রথম দিকেই আত্মসমর্পণে আসতে পারে মাদক কারবারিরা।
এদিকে গতবছর ৪ মে দেশব্যাপী শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় ৩৫ জন মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে টেকনাফেই নিহত হয়েছে ৩২ জন।

সম্পর্কিত পোস্ট