সিএনএ ডেক্স:
২০১৭ সালে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা পৌঁছানোর কাজ করতেন মো. শফিক (৩৬)। ২০২০ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী সুমির হাত ধরে ইয়াবার সঙ্গে আইসেরও নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি। সাবেক স্ত্রীর ভুয়া ক্রাইম রিপোর্টার পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই মূলত তিনি ডেমরা এলাকার মাদকের মূলহোতা বনে যান।
২০২১ সালে ১০ হাজার ইয়াবাসহ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। এক বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে চলতি বছরের আগস্টে জামিনে বের হন। পরে নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া এলাকার মাদকের গডফাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুনরায় মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন।
শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের একটি দল রোববার (১৩ নভেম্বর) মো. শফিকসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার কক্সবাজার ভিত্তিক মাদক সিন্ডিকেটের মূলহোতা মো. শফিক এবং অন্য দুজন হলেন তার সাবেক স্ত্রী ‘ক্রাইম রিপোর্টার ও টিভি আর্টিস্ট পরিচয় প্রদানকারী’ মরিয়ম বেগম ওরফে সুমি ও মো. সুমন ফকির (৩৮)। এসময় তাদের কাছ থেকে ১১ হাজার পিস ইয়াবা ও ১১০ গ্রাম আইস (ক্রিস্টাল মেথ) উদ্ধার করা হয়।
ডিএনসির ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার শুভ জানান, ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মাসুদ হোসেনের নির্দেশে মতিঝিল সার্কেলের পরিদর্শক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও সূত্রাপুর সার্কেলের পরিদর্শক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে দুটি টিম রাজধানীর ডেমরা এলাকায় রোববার (১৩ নভেম্বর) দুপুর থেকে অভিযান চালায়।
অভিযানে ডেমরা থানার পশ্চিম বক্সনগর ও স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা থেকে ১১ হাজার ইয়াবা ও ১১০ গ্রাম আইসসহ কক্সবাজার ভিত্তিক মাদক পাচারকারী চক্রের ওই তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার মো. শফিক কক্সবাজার পৌর এলাকার দক্ষিণ পাহাড়তলী ইসুলোর ঘোনা মৃত আব্দুল হাকিম মাঝির ছেলে ছেলে। মরিয়ম বেগম ওরফে সুমি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং কান্দিপাড়া খাঁবাড়ির মজিবর রহমানের মেয়ে। তারা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। তারা ডেমরা সারুলিয়া পশ্চিম বক্সনগরে থাকেন। আর সুমন ফকির বরিশাল মুলাদীর আলিমাবাদ ফকিরবাড়ীর আলেফ ফকিরের ছেলে। তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুর রায়েরবাজারের সুলতানগঞ্জে থাকেন।
অভিযান সম্পর্কে ডিএনসির সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার শুভ বলেন, সম্প্রতি ব্যবহৃত বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের উৎস অনুসন্ধানে তৎপর হয়ে ইয়াবা-আইস-এলএসডিসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। গত সপ্তাহে আইস পাচারকারী চক্রের মূলহোতা চন্দন রায়কে আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার কেন্দ্রিক একটি ইয়াবা-আইস পাচারকারী নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়। এই নেটওয়ার্কের মূলহোতা মো. শফিক (৩৬)।
শফিক ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গত বছর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে ধরা পড়ে। এক বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে গত আগস্টে জামিনে বের হন তিনি।
এরপর তিনি তার সাবেক স্ত্রী কথিত অনলাইন জেএননিউজ ডটকম-এর সাংবাদিক পরিচয়দানকারী ও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটির সদস্য এবং বাংলাদেশ টিভি ও ফ্লিম আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য পরিচয়দানকারী মরিয়ম বেগম ওরফে সুমির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার মাধ্যমে শফিক নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া এলাকার মাদকের গডফাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাবেক স্ত্রী সুমি ও চনপাড়ার মাদক কারবারিদের সহযোগিতায় তিনি পুনরায় মাদক কারবারে সক্রিয় হোন।
ক্রেতা সেজে প্রথমে যোগাযোগ করা হয় শফিকের সঙ্গে। এরপর ডিএনসির ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের কর্মকর্তারা যাত্রাবাড়ীতে যান। তবে ধূর্ত শফিক নিজে না এসে চক্রের সদস্য মো. সুমন ফকিরকে পাঠান। তাকে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে আটক করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মো. শফিককে ডেমরা থানার স্টাফ কোয়ার্টার ও সারুলিয়া এলাকা থেকে ও মরিয়ম বেগম ওরফে সুমিকে বাকি ১০ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা ও ১১০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
স্ত্রী সুমির মাধ্যমে ইয়াবার সঙ্গে আইস বিক্রি করতেন শফিক
২০১৭ সালের দিকে ইয়াবা কারবারে জড়ান কক্সবাজারের বাসিন্দা শফিক। তিনি প্রথমে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা পৌঁছানোর কাজ করতেন। পরে তিনি ২০২০ সালে মরিয়ম বেগম ওরফে সুমিকে (৩২) বিয়ে করেন। সুমিকে তাকে নিয়ে ডেমরা এলাকায় ইয়াবা-আইসের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
ডিএনসি কর্মকর্তা সুব্রত সরকার শুভ বলেন, শফিক ইয়াবা ও অত্যন্ত উচ্চমূল্যের মাদক আইস (ক্রিস্টাল মেথ) তার স্ত্রীর মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ইয়াবা পাচার ও বিক্রির ক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে স্ত্রীর সাংবাদিক ও টিভি আর্টিস্ট পরিচয়কে ব্যবহার করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া এলাকার মাদকের গডফাদারদের সঙ্গে শফিকের নিয়মিত যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে।
জব্দ ইয়াবা ও আইসের মূল্য সেবনকারী পর্যায়ে প্রতি পিস ইয়াবার মূল্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং প্রতি গ্রাম আইস (ক্রিস্টাল মেথ) চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী থানায় পৃথক নিয়মিত মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে। এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সর্বনিম্ন সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
ইয়াবা ও আইসের মূল উপাদান অ্যামফিটামিন। ইয়াবায় সাধারণত ২০-২৫ ভাগ অ্যামফিটামিন থাকে, তবে নতুন আইসে শতভাগ অ্যামফিটামিন থাকে।
ইয়াবা ও আইসের সাইকোঅ্যাকটিভ প্রভাব মারাত্মক। নিয়মিত সেবনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, মস্তিষ্ক বিকৃতি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত, শরীরে কিছু চলাফেরার অস্তিত্ব টের পাওয়া, অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা, কিডনি বিকল, চিরস্থায়ী যৌন-অক্ষমতা, ফুসফুসের প্রদাহসহ ফুসফুসে টিউমার ও ক্যান্সার হতে পারে।