ঢাকাসোমবার , ১২ নভেম্বর ২০১৮
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মেডিকেল কলেজে ২১ কোটি টাকার আসবাবপত্র ক্রয়ে কেলেঙ্কারি

প্রতিবেদক
সিএনএ

নভেম্বর ১২, ২০১৮ ৭:১৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

নিউজ ডেস্ক: কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্র কেনার নামে রীতিমতো পুকুর চুরি হয়েছে। চুরি আর অনিয়মের মাত্রা এতই বেপরোয়া যে- শুনলে যে কারোরই চোখ কপালে উঠবে! মেডিকেল কলেজটির আসবাব কেনার নামে প্রায় ২১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে এই পুকুর চুরির বন্দোবস্ত করা হয়। দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেট এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এমনকি কেনাকাটায় চরম অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও নিয়মবহির্ভুতভাবে ঠিকাদারকে বিল পাইয়ে দিতে নানান রকমের জাল-জালিয়াতি করেছে দুর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেট।
জানা যায়, এসব মালামাল কিনতে নামমাত্র দরপত্র আহ্বান করা হলেও কার্যত কোনো প্রতিযোগিতাই হয়নি। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এস এল ট্রেডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এই আসবাব সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়। এমনকি কী পরিমাণ আসবাব লাগবে, সে বিষয়ে দরপত্র নির্বাচন কমিটির কাছ থেকে কোনো চাহিদাপত্রও নেয়া হয়নি। ফলে মেডিকেল কলেজে যে পরিমাণ আসবাব দরকার তার চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় দুই গুণ সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। তবে সরবরাহকৃত প্রায় আড়াই হাজার আসবাব একেবারেই নিম্নমানের। যার প্রত্যেকটিই কেনা হয়েছে অস্বাভাবিক দামে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব আসবাবপত্র কোথায় ব্যবহার করা হবে তার জায়গা পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এদিকে নিম্নমানের এই আসবাব দিয়ে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বিল তুলে নিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে ঠিকাদারসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ চক্রটি। অবাক ব্যাপার হলো, মন্ত্রণালয়ের তদন্তে আসবাবপত্র ক্রয়ের এই ঘটনায় ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ার পরও ভাগ-বাটোয়ারা করে এই বিল তুলে নিতে চেয়েছিল সিন্ডিকেটটি। এমনকি এ খাতে অর্থ বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ (জিও) জারির মতো অপকর্মও করেছে এই সিন্ডিকেটটি।
যেভাবে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে কেনাকাটা হলো
নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো কেনাকাটায় টেন্ডার করতে হলে তারজন্য প্রথমেই দেখতে হয় বাজেটে সেই খাতে অর্থ বরাদ্দ আছে কিনা। ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কেনাকাটার জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ক্যাটাগরি অনুযায়ী মন্ত্রণালয় অথবা অধিদফতর থেকে এ ধরনের কেনাকাটায় অর্থ বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়। প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ টেন্ডার আহ্বান করবে। টেন্ডারের ক্রয়াদেশ এবং মালামাল বুঝে পাওয়ার পর ব্যয় মঞ্জুরি নিতে হয়। এরপর বিল পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
জানা গেছে, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের আসবাবপত্র কেনার জন্য ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে অর্থ বরাদ্দের জন্য লেখা হয়েছিল। কিন্তু, এই খাতে কোনো বাজেট না থাকায় অর্থ বরাদ্দ করা সম্ভব হয়নি। তারপরও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম টেন্ডার আহ্বান করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর বা মন্ত্রণালয়- কারো কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই অর্থাৎ প্রশাসনিক অনুমোদন না নিয়েই তিনি নিজের একতরফা সিদ্ধান্তে টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডারটি আসলে ওপেন টেন্ডার হিসেবে দেখানো হলেও বাস্তবে এটি ছিল ঘুপছি বা লোক দেখানো। মিঞা ছাদুল্লাহ বিন হাসান এর মালিকানাধীন এস এল ট্রেডার্সকে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল।
অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের চাকরির বয়সও শেষ হয়ে আসছিল। তাই দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মিঞা ছাদুল্লাহর সঙ্গে যোগসাজশে সরকারি অর্থ লুটপাট করতেই প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া নিয়মবহির্ভূত এ টেন্ডার আহ্বান করেন অধ্যক্ষ। ওই টেন্ডারে এমন অদ্ভূত শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, অর্থ বরাদ্দ সাপেক্ষে বিল পরিশোধ করা হবে। মিঞা ছাদুল্লাহকে সেভাবেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
যেভাবে প্রকাশ্যে এলো অনিয়ম, দুর্নীতির তথ্য 
তদন্ত প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ একক সিদ্ধান্তে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এস এল ট্রেডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে আসবাবপত্র সরবরাহের কার্যাদেশ দেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ রেজাউল করিম। এমনকি কী পরিমাণ আসবাব লাগবে, সে বিষয়ে তিনি দরপত্র নির্বাচন কমিটির কাছ থেকে কোনো চাহিদাপত্র নেননি। আর এসব অনিয়মের পথ ধরেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৩১ ধরনের ২ হাজার ৪২২টি আসবাব সরবরাহ করার সুযোগ পেয়েছে। যার অর্ধেকই কলেজের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব সিরাজুল ইসলাম ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেডিকেল কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পান, বিভিন্ন কক্ষ ও হলে প্রয়োজনীয় আসবাব বসানোর পর অবশিষ্ট আসবাব একাধিক কক্ষে স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। অনিয়মের আঁচ পেয়ে তিনি ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
আসবাব কিনতে পরতে পরতে অনিয়ম 
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাব কেনার নামে এই পুকুর চুরির ঘটনা তদন্ত করে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রে ৬২ ধরনের আসবাব সরবরাহের কথা থাকলেও তদন্তে পাওয়া গেছে ৩১ ধরনের। সরবরাহ করা আসবাব খুবই নিম্নমানের এবং এসব আসবাব দেশের নামী কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়নি। তা ছাড়া প্রয়োজনের অনেক বেশি আসবাব সরবরাহ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, একই ধরনের অনেক আসবাব কেনা হয়েছে, যা প্রয়োজন নেই। যে কারণে এসব আসবাব একাধিক কক্ষে স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, আসবাব কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও বাস্তবে কোনো প্রতিযোগিতাই হয়নি। দরপত্র নির্ধারণ কমিটি মালামালের চাহিদা নির্ধারণ না করায় ঠিকাদার চাহিদার অতিরিক্ত মালামাল সরবরাহ করেছে।
সাবেক অধ্যক্ষ রেজাউল করিম এককভাবে যে চাহিদাপত্র তৈরি করেছেন, সেখানে কয়েকটি ক্ষেত্রে রিভলবিং চেয়ার সরবরাহের কথা উল্লেখ থাকলেও সরবরাহ করা হয়েছে ফিক্সড চেয়ার। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের বসার জন্য ৩৫০টি ফিক্সড চেয়ারের দাম দেখানো হয়েছে ৬২ লাখ ৩০ হাজার। যার অর্থ প্রতিটি চেয়ারের দাম ১৭ হাজার ৮০০ করে। তদন্ত কমিটি বলেছে, এসব চেয়ারে ব্যবহার করা বোর্ড অত্যন্ত নিম্নমানের। কোনোভাবেই তার দাম এতো বেশি হতে পারে না। হলকক্ষের জন্য সরবরাহ করা দুই শতাধিক চেয়ারের দামও অস্বাভাবিক। এর প্রতিটির দাম দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা করে। চেয়ারগুলো বিভিন্ন রঙের হওয়ায় খুবই অসুন্দর দেখায়। যাচ্ছেতাই মানের ২০টি সোফার প্রতিটির দাম দেখানো হয়েছে ৯৫ হাজার ৫০০ করে। পরিদর্শনে দেখা যায়, দু’জন বসার উপযোগী নিম্নমানের এসব সোফার কোনোটির হাতল আলাদা হয়ে আছে কোনোটি আছে  নড়বড়ে অবস্থায়। যদিও দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি আসবাব কোম্পানির সুদৃশ্য এক সেট সোফার বর্তমান বাজার মূল্য ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। যার প্রতিটি সেটে রয়েছে দুজনের বসার উপযোগী দুটি ও একজনের উপযোগী একটি করে সোফা এবং একটি টি-টেবিল। ৩০০টি সিঙ্গেল খাটের প্রতিটির দাম দেখানো হয়েছে ৬২ হাজার ৫০০ টাকা করে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০টি ডাবল খাটের প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা করে। ২৫টি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের প্রতিটির দাম ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা করে। ৬০টি সাধারণ টেবিলের প্রতিটির দাম ৪১ হাজার ২৫০ টাকা করে। কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য ৪৫টি টেবিলের প্রতিটির দাম ৯৮ হাজার ৪৭৫ টাকা করে। ২০টি টি-টেবিলের প্রতিটির দাম ৩০ হাজার ৫০০ টাকা করে। ২০টি খুবই নিম্নমানের অসুন্দর ডাইনিং টেবিলের প্রতিটির দাম দেখানো হয়েছে ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা করে।
তদন্ত কমিটি বলছে, এসব কেনাকাটার সব কিছুই হয়েছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এবং অধ্যক্ষ রেজাউল করিমের একতরফা সিদ্ধান্তে।
দুর্নীতি ধরা পড়ার পরও বিল পরিশোধে ডা. রশিদের অপচেষ্টা
২০১৭ সালের জুনে এস এল ট্রেডার্স মালামাল সরবরাহের পর পরই তৎকালীন অধ্যক্ষ রেজাউল করিম অবসরে চলে যান। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হয়ে আসেন সুভাস চন্দ্র সাহা। মালামাল সরবরাহকারী এস এল ট্রেডার্সের মালিক দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মিঞা ছাদুল্লাহ বিল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। কিন্তু এরই মধ্যে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজটি সরেজমিন পরিদর্শনের সময় অনিয়ম-দুর্নীতি নজরে আসায় তিনি এ ব্যাপারে তদন্তের ব্যবস্থা করেন। তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিতও হয়। কিন্তু তারপরও বসে থাকেননি দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার মিঞা ছাদুল্লাহ। তিনি মোটা অংকের অর্থে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের নতুন অধ্যক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করেন। অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দিয়ে এরা মিঞা ছাদুল্লাহকে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেন। এতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. আবদুর রশিদ। প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. আবদুর রশিদকে ম্যানেজ করে তাকে দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দের জন্য চিঠি লেখান মিঞা ছাদুল্লাহ। ডা. আবদুর রশিদ এই মর্মে চিঠি লেখেন, উন্নয়ন খাতে অর্থ বরাদ্দ নেই। কিন্তু কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের আসবাবপত্র কেনার টেন্ডার হয়েছে। মালামাল রিসিভ করেছে। উন্নয়ন খাতে যেহেতু অর্থ বরাদ্দ নেই রাজস্ব খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। অথচ রাজস্ব খাত থেকে এ ধরনের অর্থ বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই সেটি ডা. রশিদ নিজেও ভালো করে জানেন।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোড পরিবর্তন করে উন্নয়ন খাতে অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে লিখেছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়। তারপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক অনুমোদনের চিঠি ইস্যু করে। এই খাতে অর্থ না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে প্রশাসনিক অনুমোদনের চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল সেটিই এক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন। এ সংক্রান্ত ফাইল মন্ত্রী পর্যন্তও অনুমোদিত হয়েছিল। তারপরই প্রশাসনিক অনুমোদনের চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। অথচ জাল-জালিয়াতি ধরা পড়ে যাবার পর মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখন এটিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য বলছেন, প্রশাসনিক অনুমোদনের চিঠি অর্থাৎ জিও-টি মন্ত্রণালয়ের ইস্যু করা নয়। এই জিও ভুয়া বলে তারা দাবি করছেন। শুধু প্রশাসনিক অনুমোদনের জিও-ই নয়, এ বিষয়ে ব্যয় মঞ্জুরির জিও পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইস্যু করেছিল বলে ঠিকাদার মিঞা ছাদুল্লাহ এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। যদিও মন্ত্রণালয় এখন নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য এগুলোকে ভুয়া বলে দাবি করছে।
কিন্তু, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এস এল ট্রেডার্সের মালিক মিঞা ছাদুল্লাহ শীর্ষ কাগজের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, প্রশাসনিক অনুমোদনের জিও-টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই ইস্যু করা। এ সংক্রান্ত ফাইল মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত অনুমোদন হয়েছে। তারপরই জিও ইস্যু হয়েছে। অথচ এখন তারা বলছেন, জিও ইস্যু হয়নি। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এখন তাদের জিও-কে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করছেন। ফাইলটি খতিয়ে দেখা হলেই আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে।
ডা. রশিদ সিন্ডিকেটের তৎপরতায় যেভাবে অবৈধ জিও জারি হলো
অধিদফতরের পরিচালক ডা. রশিদ কোড পরিবর্তন করে এ খাতে অর্থ বরাদ্দের জন্য চিঠি লিখলেও অর্থ মন্ত্রণালয় এই অবৈধ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটটি বেকায়দায় পড়ে যায়। মিঞা ছাদুল্লাহর বিল পরিশোধের জন্য এরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাসহ মন্ত্রণালয়ের উপর প্রভাব খাটিয়ে এরা প্রশাসনিক অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরির জিও ইস্যু করেন। যেহেতু মন্ত্রণালয়ের উপর ডা. রশিদের প্রভাব অনেক, তাই তার পক্ষে এই অবৈধ কাজটি করা সম্ভব হয়েছে।
তবে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার সহকারী সচিব মো. শাহজাহান এবং কম্পিউটার অপারেটর (যিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেন) অন্যতম সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। এরা দু’জন মিঞা ছাদুল্লাহর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ পেয়েছেন। এ খাতে অর্থ বরাদ্দ না থাকার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র জিও জারির প্রস্তাব দিয়ে এরা ফাইল উপরের দিকে উপস্থাপন করেছেন এবং সেভাবেই ফাইলটি অনুমোদিত হয়েছে। জিও-তে স্বাক্ষর করেছেন সহকারী সচিব মো. শাহজাহান।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এস এল ট্রেডার্সের মালিক মিঞা ছাদুল্লাহ গত বছরের শেষের দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রশাসনিক অনুমোদন এবং ব্যয় মঞ্জুরির ওই দু’টি জিও (সরকারি আদেশ) কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে জমা দেন। এর ওপর ভিত্তি করে ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ সুভাষ চন্দ্র সাহা ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বিল অনুমোদন ও বরাদ্দ দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি লেখেন।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পূর্বেকার চিঠির জবাবে ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব ফয়সাল শাহ এই মর্মে একটি চিঠি ইস্যু করেন যে, ঠিকাদারের বিল পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ নেই। রাজস্ব খাতের টাকা থেকে বিল পরিশোধ করা সম্ভব হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় তাতে সম্মতি দেয়নি। ফয়সাল শাহ’র ওই চিঠি ইস্যুর পরই আসল ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। শুরু হয় তোলপাড়। অর্থ বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে প্রশাসনিক অনুমোদন ও ব্যয় মঞ্জুরির জিও জারি হলো- এ প্রশ্ন সামনে এসে যায়। তাছাড়া ইতিপূর্বে মন্ত্রণালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলামের সরেজমিন পরিদর্শন এবং যুগ্মসচিব (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও কীভাবে এই বিল পরিশোধ করা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন সামনে আসে। ফলে নতুন করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী একেএম মহিউল ইসলামের নেতৃত্বে। এই কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রশাসনিক অনুমোদনের জিও-টি সঠিক না ভুয়া এটি তদন্ত করে বের করার জন্য। কমিটি দায়সারা গোছের তদন্তের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বাঁচিয়ে দেয়। বলা হয়, জিও-টি ভুয়া। কিন্তু, ঠিকাদার মিঞা ছাদুল্লাহ দাবি করেছেন, এই জিও ভুয়া নয়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনিক অনুমোদনের অবৈধ জিও জারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর পরই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার সহকারী সচিব মো. শাহজাহানকে এ ব্যাপারে অন্যত্র শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। প্রশ্ন হলো, জিও যদি ভুয়া-ই হতো তাহলে কেন সংশ্লিষ্ট সহকারী সচিবকে অন্যত্র শাস্তিমূলক বদলি করা হলো?
পুরো ঘটনা আসেনি তদন্ত রিপোর্টে 
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুর রশিদ আসবাব ক্রয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম আর তদন্ত প্রতিবেদনের কথা ধামাচাপা দিয়ে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারের পক্ষে সাফাই গেয়ে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি লেখেন।
স্বাভাবিকভাবেই এতে প্রমাণিত হয়, কক্সবাজার মেডিকেলে কেনাকাটায় অনিয়মের এই গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচালক ডা. রশিদ ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, তিনি যদি এই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত না থাকতেন তাহলে এই কেনাকাটায় অনিয়মের ঘটনা জেনেও বিল বরাদ্দ দিতে সুপারিশ করে চিঠি লিখতেন না। বরং বাধ সাধতেন। এছাড়া এই খাতে বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দ চেয়ে সুপারিশ করাও অস্বাভাবিক। কারণ রাজস্ব খাতের অর্থ কখনো উন্নয়ন খাতে স্থানান্তর হয় না বা স্থানান্তরের সুযোগ নেই, এটা তিনি নিজেও জানেন; তারপরও কেন তিনি এ ধরনের অবৈধ সুপারিশ করলেন। এ বিষয়টি কোনো তদন্তেই খতিয়ে দেখা হয়নি। পরের তদন্ত কমিটির প্রধান কাজী একেএম মহিউল ইসলাম এ ব্যাপারে শীর্ষ কাগজের প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তাই তিনি সেই বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে কোনো মন্তব্য করেননি। মহিউল ইসলাম জানান, তাকে শুধু প্রশাসনিক অনুমোদনের জিও সঠিক নাকি ভুয়া- এটি তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের টেন্ডারটির কোনো জিও মন্ত্রণালয় জারি করেনি। ঠিকাদার যে জিও দেখিয়েছেন তা পুরোপুরিই ভুয়া। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এই জিওটি ভুয়া নয়। মূলত আটকে যাওয়া বিল হাতিয়ে নিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটটি এই জিও জারি করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে তা হজম করতে না পারায় এটিকে ভুয়া হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে অধিদফতরের ‘মোস্ট পাওয়ারফুল’ পরিচালক ডা. রশিদের বদৌলতে।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে আসবাবপত্র কেনাকাটায় শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যক্ষকে এককভাবে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে ঠিকাদারসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ চক্র জড়িত। যারা আসবাব ক্রয়ের নামে এই ২১ কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে চেয়েছিলো। যেই চক্রের নেতৃত্বে আছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. আবদুর রশিদ। মূলত এই চক্রের রাঘব বোয়ালদের বাঁচাতে শুধুমাত্র অধ্যক্ষ রেজাউলকে এককভাবে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। কেননা এই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের প্রধান ডা. রশিদ ‘মোস্ট পাওয়ারফুল’ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। আর সে কারণেই এই ঘটনায় তার মুখোশ উন্মোচন করা হয়নি।
সূত্রমতে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবৈধ কর্মকা-কে বৈধতা দিতে ঘুষ তোলার মূল দায়িত্ব পালন করেন মূলত স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ পরিচালক আবদুর রশিদ। তার নেতৃত্বে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অনুমোদন, লাইসেন্স নবায়ন-স্থগিত, কলেজ ও হাসপাতালের পরিবেশ মনিটরিং, পরিদর্শন, ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির আসন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ঘুষ তোলা-ই হচ্ছে ওই সিন্ডিকেটের মূল কাজ। এর আগে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্র ভর্তির অনুমোদন নবায়ন, আসন বাড়ানো- প্রভৃতিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. মো. আবদুর রশিদ ও তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। তদন্তেও তার দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।সুত্র:(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২২ অক্টোবর ২০১৮ প্রকাশিত)

 

 

সম্পর্কিত পোস্ট