লবণের জাহাজ ফিশিং ট্রলারে মাদক পাচার, প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার, গা-ঢাকা দিয়েছে বদির পরিবার

হাসান আল জাভেদ, আমাদের সময় কক্সবাজার থেকে
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পরপরই পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকা। রমজানের বাজারে আগের মতো কেনাকাটার ধুমধাম নেই, মসজিদে মুসল্লি নেই। শোঁ শোঁ করা দামি মোটরসাইকেল হাঁকানো আর হাতে ২-৩টি করে আইফোন ব্যবহারকারী তরুণ-যুবকদের মেলে না শহরের রাস্তায়। স্থানীয়রা জানান, সারাদেশে বন্দুকযুদ্ধ বিশেষ করে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক নিহতের ঘটনার পর এলাকায় থাকা বা ঢাকা-চট্টগ্রামমুখী সড়ক হয়ে আত্মগোপনে শঙ্কা তৈরি হয়। নতুন-পুরান তালিকায় থাকা মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদার বা পৃষ্ঠপোষকদের একটি অংশ রাতের আঁধারে মিয়ানমারের মংডুতে আশ্রয় নিয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সমন্বিত তালিকার রেড লিস্টে আছেন টেকনাফ গুদারবিলের আলী আহমেদ চেয়ারম্যানের ছেলে জিয়াউর রহমান। শুধু ইয়াবা ব্যবসায় ব্যবহারের জন্য চেয়ারম্যান পরিবারের একাধিক ফিশিং ট্রলার রয়েছে। মাছের মৌসুমে ঘরের কাছের সাগরজলে খানিকের জন্য জাল ফেলা না হলেও এসব ট্রলার দিয়ে নিয়মিত নাফ নদ পেরিয়ে ইয়াবার চালান আনতেন জিয়াউর রহমান। আবার সড়কপথে ঢাকায় পাচার করতেন। তার মতো ফিশিং ট্রলার দিয়ে সাগরপথে ইয়াবা পাচার করেন লম্বরী গ্রামের মীর কাশেম আলী মেম্বার। মানুষের মুখে সমুদ্রপথে ইয়াবা রুটের নিয়ন্ত্রক বা ডন তিনি। র্যাব-পুলিশের ‘চরমপন্থা’ শুরুর পর তাদের ট্রলার দিয়ে রাতের আঁধারে মিয়ানমার পালিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি অংশ। স্থানীয়দের কেউ কেউ বলছেন, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজাহান, মীর কাশেম আলী ও জিয়াউর রহমান মিয়ানমার পালিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, পলায়নের পথে জিয়াউর রহমান একটি সংস্থার হাতে আটক হয়েছেন। জিয়াকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে। তার বিরুদ্ধে ৪টি মাদকের মামলা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে ১০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। প্রতিপক্ষ দমনে তাকে দিয়ে ক্যাডার হিসেবেও ব্যবহার করতেন বদি। তবে নিজ বাসভূমিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া না হলেও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা যে মংডুতে আশ্রয় নিয়েছেন, সেটি অনেকেই নিশ্চিত করেছেন।

সূত্র জানায়, শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী টেকনাফ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে করে কক্সবাজার থেকে ঢাকা চলে যান এমপি আবদুর রহমান বদি। জাফর চেয়ারম্যানের ছেলে ইয়াবার গডফাদার মোস্তাক আহমেদ গত ৩ থেকে ৪ বছর ধরে এলাকাছাড়া। বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান, আব্দুস শুক্কুর, সৎ ভাই সফিক কোম্পানি গা-ঢাকা দিয়েছেন। দুবাই থেকে ইয়াবা, স্বর্ণ ও হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন জাফর ওরফে টিটি জাফর। বদির ভাগ্নে সাহেদুর রহমান নিপু মিয়ানমার হয়ে ভারতের আসাম পাড়ি জমিয়েছেন। গত কদিনে নিরুদ্দেশ নাজিরপাড়ার টেকনাফ ইসলামাদের হোসেন ওরফে বর্মাইয়া হোসেন, নাজিরপাড়ার হাজী ইসলামের দুই ছেলে আবদুর রহমান ও জিয়ার বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালানের ৪টি করে মামলা রয়েছে।
আত্মগোপনে চলে গেছেন টেকনাফের ইয়াবাপাড়া ‘নাজিরপাড়ার’ এজাহার মিয়ার ছেলে নুরুল হক ভুট্টো ওরফে দাঙ্গা ভুট্টো। পেটোয়া বাহিনী গড়ে তুলে ইয়াবা ব্যবসা ছাড়াও জমি দখল, পর্যটকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, মানবপাচারসহ টেকনাফের সব অপরাধের উঠতি ভিলেন তিনি। একাধিকবার গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্তি পেলেও সিনেমাস্টাইলে কক্সবাজারের কথিত সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের জেল ফটকে হাজির করে ঢাকঢোল পিটিয়ে বের হতেন তিনি। সেই ভুট্টোর বাড়িতে এখন পুরুষ তো দূরের কথা নারীদেরও দেখা মেলে না। স্থানীয়রা বলছেন, ভুট্টো কোথায় আছে তাদের জানা নেই। তবে তার ক্যাডার বাহিনী বা তরুণ ইয়াবা বাহিনী নাফ নদ পেরিয়ে মিয়ানমার আশ্রয় নিয়েছে। উখিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বদির শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী প্রকাশ্যে থাকলেও পলাতক রয়েছেন বদির সহযোগী বালুখালীর ফজল কাদের ভুট্টো, এমপির ইয়াবা ও ডিও লেটার সিন্ডিকেট প্রধান ফলিয়াপাড়া তহিদুল আলম, আবদুল হক, মীর আহমেদ।
এদিকে মাদকের গডফাদার, পৃষ্ঠপোষক বা সিন্ডিকেট সদস্যরা আত্মগোপনে গেলেও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। রুট বা স্পট বদল, কৌশল বদল করে চোরাচালান হচ্ছে ঘাতক বড়ি ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে সাগরপথে ইয়াবার চালান মহেষখালী-কুতুবদিয়া এনে সেখান থেকে লবণ বোঝাই ট্রলারে সরাসরি চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে সরবরাহ করা হচ্ছে। আরেকটি অংশ যাচ্ছে সেন্টমার্টিন হয়ে। তবে টেকনাফ শহরসংলগ্ন ইয়াবার কুখ্যাত রুট নাজিরপাড়া, চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, সাবরাং হয়ে ইয়ারা চোরাচালান কমে গেছে। ইয়াবা আসছে বান্দরবানের গহিন পাহাড় দিয়ে। গহিন পাহাড়ে বিজিবির একটি বিওপি থেকে আরেকটি বিওপি যেতে সময় লাগে কমপক্ষে একদিন। সেসব এলাকা দিয়ে ইয়াবা পাচারের নতুন রুট তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। বাহকদের ধরনও বদলে গেছে। তবে রুট বা বাহক বদল হলেও পৃষ্ঠপোষক বা নিয়ন্ত্রক এমপি বদিই।
কক্সবাজারে কর্তব্যরত সব সংস্থা মিলে ২০ মে থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৯ দিনে ৪ লাখ ৪২ হাজার ইয়াবা আটক হয়। র্যাব-৭ কক্সবাজারের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বলেন, অপারেশন শুরুর পর এখানে যারা মাদকের গডফাদার বা পৃষ্ঠপোষক তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন বা পালিয়ে গেছে। ইয়াবা চোরাচালানও কমে গেছে। যারা ইয়াবা বহন করে তাদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত। পেটের দায়ে তারা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও এই কাজটি করে যাচ্ছে। কিন্তু বাহকরা এলাকাতেই রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে যেমন মামলা নেই, তেমনি এতসংখ্যক মানুষকে শনাক্ত করাও অসম্ভব। আটক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবার আকার ক্ষুদ্র হওয়ায় যতদিন এর চাহিদা আছে, ততদিন চোরাচালান বন্ধ সম্ভব নয়। সারাদেশে চাহিদার কারণে বিশেষ অভিযানের মধ্যেও গত কয়েক দিনে ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। এ সময়ে চোরাকারবারিরা আত্মগোপনে গেলেও জীবিকার টানে বাহক বা সরবরাহকারীরা নানা কায়দায় ইয়াবা বহন করে আসছে। যদিও চোরাচালানের হার আগেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশেরও কমে নেমে এসেছে।
প্রতিবন্ধী নারী-শিশু, বিধবা, কলেজ পড়–য়া ছাত্রী, বাসের চালক-হেলপার, কাভার্ড ভ্যান হয়ে ইয়াবা পাচার হচ্ছে। এতে সরাসরি না গিয়ে ঘাটে ঘাটে বাহক পরিবর্তন করা হচ্ছে।
গত ২২ মে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা থেকে ৩০ হাজার ইয়াবাসহ আলী উল্লাহ জিন্নাহ নামে একজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। একই দিন কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে আলী জোহর নামে এক পাচারকারীকে ২ হাজার ইয়াবাসহ এবং ২৪ মে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৬ হাজার ইয়াবাসহ একটি পরিবহনের চালক আবদুল আজিজ শেখ ও তার গাড়ির সুপারভাইজার সোহেল রানাকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের টিম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক আব্দুল মালেক তালুকদার বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলেও কিন্তু চোরাকারবারিরা থেমে নেই। এরা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে ঢাকাসহ সারাদেশে ইয়াবা পাচারের চেষ্টা করে আসছে। বাসের চালক-হেলপার থেকে শুরু করে এখন শারীরিক প্রতিবন্ধীদের দিয়ে ইয়াবা বহনের চেষ্টা করছে। আমরাও কৌশল নিয়ে তাদের আটকের চেষ্টা করছি। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, স্থলপথে এখন ইয়াবা পাচার নেই বললেই চলে। এখন সাগরপথে সরাসরি চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ইয়াবা চলে যাচ্ছে। ইয়াবার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভেতর পটুয়াখালীতে একটি ফিশিং বোটে ইয়াবা আটকের কথা জানান তিনি।

Share this:
- Click to share on Twitter (Opens in new window)
- Click to share on Facebook (Opens in new window)
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window)
- Click to share on Tumblr (Opens in new window)
- Click to share on Reddit (Opens in new window)
- Click to share on Pocket (Opens in new window)
- Click to share on Pinterest (Opens in new window)
- Click to share on Skype (Opens in new window)
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window)
- Click to share on Telegram (Opens in new window)
- Click to print (Opens in new window)